অথবা , বর্তমান যুগে প্লেটোর রিপাবলিক এর রাষ্ট্রদর্শন পর্যালোচনা কর ।
অথবা , বর্তমান যুগে প্লেটোর রিপাবলিক এর বিশ্লেষণ কর ।
উত্তর ৷ ভূমিকা : মহান দার্শনিক প্লেটো রচিত ‘ দি রিপাবলিক ‘ ( The Republic ) বিশ্ব সাহিত্যের একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ । এ গ্রন্থের মাধ্যমে প্লেটো রাষ্ট্রনীতির যে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন , তা আজও বিশ্বে বিরল অবদান বলে স্বীকৃত আছে । গ্রিক নগরসভ্যতার সাথে প্লেটো ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন । সমাজ ও রাজনীতির সাথে ছিল তার বাস্তব সম্পর্ক । গ্রিক নগররাষ্ট্রের ক্রান্তিলগ্নে প্লেটো যে সমস্যা কণ্টকাকীর্ণ জীবনের মধ্যে বাস করেছেন , মূলত রিপাবলিক হচ্ছে তা থেকে মুক্তির প্রয়াস । গ্রিক নগররাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা যখন অভিজাততন্ত্র , কতিপয়তন্ত্র , স্বৈরতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের চক্রাবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছিল , তখন আদর্শ রাষ্ট্রের নীল নকশারূপে ‘ The Republic ‘ শাসকদের সামনে আবির্ভূত হয় নতুন দিনের আলো নিয়ে ।
বর্তমান যুগে প্লেটোর ‘ Republic ‘ এর মূল্যায়ন : প্লেটোর সমগ্র ‘ রিপাবলিক ‘ গ্রন্থটি দশটি পুস্তকে বিভক্ত । গ্রন্থটির অষ্টম ও নবম পুস্তকের একাংশে আদর্শ রাষ্ট্রের বিচ্যুতি হিসেবে প্লেটো কতকগুলো রাষ্ট্র সম্পর্কে আলোচনা করেছেন । সেসব রাষ্ট্র গ্রিক রাষ্ট্রসমূহেরই উদাহরণ । তবে শুধু গ্রিক সমাজকে নিয়েই রিপাবলিক গ্রন্থে আলোচনা হয় নি , এ আলোচনায় আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থারও ইঙ্গিত রয়েছে । আবার রাজনীতি ও সামাজিক বিষয়সমূহের আলোচনা করা হয়েছে দ্বিতীয় , তৃতীয় ও চতুর্থ পুস্তকে । এসব পুস্তকের আলোচনার বিষয়বস্তু হলো রাষ্ট্রের প্রাথমিক গঠন , সমৃদ্ধতর রাষ্ট্র , শাসকের আবশ্যকীয় গুণ , রাষ্ট্রের নাগরিকদের শ্রেণীবিভাগ , শাসকদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পারিবারিক সম্পর্ক প্রভৃতি । এসব আলোচনা কোন দৃষ্টান্তের বিস্তারিত বর্ণনার উপর ভিত্তি করে হয় নি । এসব বিষয়ের অন্তর্গত নীতির উপরই প্লেটো জোর দিয়েছেন । গ্রন্থের বাকি অংশ ছিল প্রধানত ন্যায় , শিক্ষা , দর্শন , কাব্য এবং আত্মার অমরতা বিষয়ক আলোচনা ।
এজন্য Rousseau ( রুশো ) বলেছেন , ” Republic কে রাজনৈতিক গ্রন্থ না বলে শিক্ষা সম্পর্কিত সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ বলা যেতে পারে । ” একথা ঠিক বর্তমান যুগেও প্লেটোর ‘ Republic ‘ গ্রন্থ থেকে অনেক কিছু জানার বা শিক্ষার আছে । তাই প্লেটো সম্পর্কে জ্ঞান লাভেরও সার্থকতা রয়েছে । একইরকম প্রশংসা করে লেখক উইল ডুরান্ট ( Will Durant ) বলেন , “ প্লেটোর সংলাপ বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডারের অমূল্য সম্পদ এবং সমস্ত সংলাপের মধ্যে রিপাবলিক হচ্ছে সর্বোত্তম । রিপাবলিক একখানি সামগ্রিক তত্ত্বগ্রন্থ । বলা চলে এ গ্রন্থে সমগ্র প্লেটো একখানি গ্রন্থের আকার লাভ করেছেন । আবার প্লেটোর রিপাবলিক এর সার্থক ইংরেজি অনুবাদক অধ্যাপক বেঞ্জামিন জোয়েট ( B. Jowet ) বলেন , রিপাবলিক ’ অবশ্যই প্লেটোর শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থ ।
রিপাবলিকের মধ্যে আমরা প্লেটোর দৃষ্টির যে বিস্তার দেখতে পাই এবং সংলাপ নীতির উৎকর্ষের যে চরম সাফল্য রিপাবলিক এ অর্জিত হয়েছে এর নিদর্শন অপর কোন সংলাপে নেই । জগৎ এবং জীবনের জ্ঞানের এমন ব্যাপ্তি চিন্তার ক্ষেত্রে শুধু এক যুগের নয় সকল যুগের নতুন এবং পুরাতনের এ সম্মিলন অপর কোন সংলাপে আমরা দেখি না । The Republic হচ্ছে প্লেটোর সকল সংলাপের কেন্দ্রবিশেষ । রিপাবলিককে কেন্দ্র করেই অপর সকল সংলাপ গ্রথিত হয়েছে ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে , প্লেটোর ‘ Republic ‘ নীতিমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পর্কিত একটি একক গ্রন্থ । এখানে ‘ মানুষকে চিন্তা করা হয়েছে রাষ্ট্রের সভ্য হিসেবে , আর রাষ্ট্রকে চিন্তা করা হয়েছে একটি নৈতিক সংগঠন হিসেবে । ‘ রিপাবলিক ’ মূলত বাস্তব উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত একটি গ্রন্থ ; ‘ Republic ‘ মনের দর্শন । তবে তা কেবল মনকে বিশ্লেষণ করার জন্য নয় মানুষকে সতর্ক করা ও পরামর্শ দেয়ার জন্যও । এ গ্রন্থে প্লেটো মানুষের মুক্তির জন্য সত্যকে অনুসন্ধান করেছেন । সুতরাং প্লেটো সম্পর্কে জ্ঞান লাভের আবশ্যকতা বর্তমান যুগেও রয়েছে একথা বলা যায় ।
প্রশ্নঃ প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর ।
অথবা , প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য মূল্যায়ন কর ।
অথবা , প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ পর্যালোচনা কর ।
উত্তর ভূমিকা : গ্রিস রাষ্ট্রের অস্থিতিশীলতা , দেশের যুদ্ধাবস্থা প্রভৃতির অবসানকল্পে প্লেটো তাঁর বিখ্যাত ‘ The Republic ‘ গ্রন্থে একটি আদর্শ রাষ্ট্রের বর্ণনা দেন । প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের বর্ণনা করতে গিয়ে তাঁরই গুরু মহাজ্ঞানী সক্রেটিসের মূলনীতি ‘ Virtue is knowledge ‘ এবং ‘ বা আদর্শ তাই বাস্তব ‘ প্রভৃতি নীতি দ্বারা যথেষ্ট পরিমাণে প্রভাবিত হয়েছেন । মূলত প্লেটো তাঁর ‘ The Republic ‘ গ্রন্থে যে আদর্শ রাষ্ট্রের বর্ণনা দিয়েছেন তার মূল উদ্দেশ্য হলো সুন্দর বা শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন ।
প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য : প্লেটো তাঁর রিপাবলিকের মধ্যে যে আদর্শ রাষ্ট্রের চিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন তার মধ্যে নিম্নলিখিত কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য :
১. শ্রেণীভিত্তিক প্রতিষ্ঠান : প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র একটি শ্রেণীভিত্তিক প্রতিষ্ঠান । এ রাষ্ট্রের অধিবাসীরা প্রধানত তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত । এ তিনটি শ্রেণী নিম্নরূপ :
ক . অভিভাবক শ্রেণী : প্লেটো তাঁর কল্পিত আদর্শ রাষ্ট্রের শাসনভার অভিভাবক শ্রেণী অর্থাৎ দার্শনিক রাজাদের হাতে ন্যস্ত করতে চেয়েছেন । এ অভিভাবক শ্রেণী হচ্ছে সর্বোচ্চ জ্ঞানের অধিকারী ।
খ . যোদ্ধা শ্রেণী : শ্রেণীবিন্যাসের দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে যোদ্ধা শ্রেণী । এরা হচ্ছে সাহস এবং শক্তির অধিকারী । রাষ্ট্র রক্ষা এবং প্রজাদের সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব এদের উপর ন্যস্ত ।
গ . উৎপাদক শ্ৰেণী : শ্রেণীবিভাগের নিম্নস্তরে রয়েছে শ্রমিক বা উৎপাদক শ্রেণী । রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য উৎপাদনের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে শ্রমিক শ্রেণী ।
২. শ্রমবিভাগ ও বিশেষীকরণ : প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্রকে শ্রমবিভাগ ও বিশেষীকরণের নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন । এখানে যোগ্যতার মাপকাঠিত্বে কর্ম নির্ধারিত হয় ।
৩. সাম্যবাদ : প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রে অভিভাবক শ্রেণীর উপর সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে । তাদের কোন ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং পরিবার থাকবে না । তারা কেবল রাষ্ট্র শাসনে মনোযোগী হবেন ।
৪. বাধ্যতামূলক শিক্ষাব্যবস্থা : প্লেটোর কল্পিত আদর্শ রাষ্ট্রে শিক্ষাব্যবস্থাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং এ শিক্ষাব্যবস্থা হবে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ।
৫. ন্যায়বিচার : ন্যায়বিচার হচ্ছে প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য । তাঁর মতে , একমাত্র আদর্শ রাষ্ট্রে সর্বোত্তম ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত ।
৬. গণতন্ত্রের স্থান ছিল না : প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের কোন স্থান ছিল না । তিনি মনে করতেন , জ্ঞান বুদ্ধিতে সবাই সমান হতে পারে না , তাই রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে সবাই মতামত দিতেও পারে না । এজন্য তিনি গণতন্ত্রকে মূর্খের শাসন হিসেবে অবহিত করেছেন ।
৭. আইনের অনুপস্থিতি : প্লেটো মনে করেন , আদর্শ রাষ্ট্রের দার্শনিক রাজাগণ যেহেতু সর্বোচ্চ জ্ঞানের অধিকারী সেহেতু এখানে আইনের কোন প্রয়োজন নেই । প্লেটো বলেছেন , যখন শাসকগণ ন্যায়পরায়ণ থাকে , তখন আইন নিষ্প্রয়োজন আর যখন শাসকগণ দুর্নীতিপরায়ণ হন , তখন আইন অকার্যকর ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে , প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রতত্ত্বের পরিকল্পনা কল্পনা বিলাসমাত্র বা সম্পূর্ণরূপে সর্বাত্মক প্রকৃতির ; তথাপি এ তত্ত্বের কিছু গুণ লক্ষ্য করা যায় । আধুনিক যুগের ক্ষমতা পৃথকীকরণ নীতি প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র তত্ত্ব মতবাদের নিকট দায়ী । মোটকথা , বিশ্ব সভ্যতার অগ্রগতি সাধনে যেসব মনীষীর অবদান চিরভাস্কর , তাঁদের মধ্যে গ্রিক চিন্তাবিদ প্লেটোর তত্ত্ব অন্যতম । আর এ বিখ্যাত মনীষীর চিন্তাধারার মধ্যে আদর্শ রাষ্ট্র তত্ত্বটি অন্যতম ।