বাংলায় সুফিবাদ বিকাশের সময়কার সামাজিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে আলোচনা কর।

অথবা, বাংলায় সুফিবাদের সামাজিক প্রেক্ষাপট বর্ণনা কর।
অথবা, সুফিবাদ বিকাশে তৎকালিন বাংলার সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে যা জান লিখ।
অথবা, বাংলাদেশে সুফিবাদের বিকাশের প্রাথমিক স্তরের সমাজচিত্র বা প্রেক্ষাপট তুলে ধর।
উত্তর।৷ ভূমিকা :
সুফিবাদ ইসলামি ভাবাদর্শের অভ্যন্তরীণ বা বাতেনি দিকের সর্বোচ্চ স্তরের বিকশিত চিন্তাধারা সুফিবাদ ইসলাম ধর্মের উদ্ভবের উষালগ্ন থেকেই বিকশিত একটি মরমিবাদী ধ্যান অনুধ্যানমূলক আধ্যাত্মিক সাধন পদ্ধতি হলেও বাংলায় এই মতাদর্শের অনুপ্রবেশ কখন কিভাবে ঘটছে তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা প্রায় অসম্ভব। তবে অনুমান করা হয় সপ্তম অষ্টম শতকে বাংলায় সুফিবাদের সূচনা হলেও এগার শতকে মুসলমানগণ কর্তৃক বাংলা বিজয়ের পর সুফিবাদ বাঙালির জীবনদর্শনে একটি উল্লেখযোগ্য ও পরিপূর্ণ স্থান দখল করে। বলা যায় মধ্যযুগীয় বাংলার এক ঐতিহাসিক সামাজিক প্রেক্ষাপটে সুফিবাদ বাংলায় তার স্বীয় আধিপত্যকে প্রতিষ্ঠা করে।

বাংলায় সুফিবাদ বিকাশের সামাজিক প্রেক্ষাপট : বাংলায় যে সামাজিক প্রেক্ষাপটে সুফিবাদের প্রচার ও প্রসার ঘটে তা ইসলাম ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে এক ঐতিহাসিক অধ্যায়ের সূচনা করে। কেননা, বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা যেমন সুফিবাদের প্রচার ও প্রসারকে মহীরূহ দান করে তেমনি সুফিবাদের আদর্শ এদেশে মুসলিম শাসনের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করতে যথেষ্ট সহায়তা দান করে। মধ্যযুগের বাংলার সামাজিক ও ধর্মীয় ইতিহাস অধ্যয়ন করলে জানা যায় যে, আরব, ইরাক, ইরান, তুর্কিস্তান প্রভৃতি অঞ্চল হতে আগত মুসলিম বণিক, সুফি দরবেশ ও শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় এদেশে ইসলামি ভাবধারা অতি সহজেই প্রচারিত হয়। আর এদেশে ইসলাম প্রচারে যারা অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেন তন্মধ্যে সুফি সাধকগণ ছিলেন অগ্রপথের পথিক। কেননা, সুফি সাধকদের জীবন প্রণালি ছিল আকর্ষণীয়, শিক্ষণীয় ও সাদাসিধা। আচার আচরণে ও পোশাক পরিচ্ছেদে এঁরা ছিল অতি সাধারণ ও বিনয়ী। ফলে তাঁরা যখন একটি উদারধর্মী পূর্ণাঙ্গ জীবনাদর্শের প্রতি এদেশবাসীকে আহ্বান জানান। তখন বিনা দ্বিধায় এদেশের হিন্দু বৌদ্ধ তথা আপামর জনসাধারণ তা গ্রহণ করতে এগিয়ে আসেন। তবে এ গণধর্মান্তরের পশ্চাতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে কারণটি বিদ্যমান ছিল তা হলো তৎকালীন বাংলায় বিদ্যমান সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট।তৎকালীন বাঙালি সমাজে অর্থাৎ মুসলমানদের আগমনের প্রাক্কালে এদেশে হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকেরা বাস করতো। হিন্দুরা ছিল রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত জাতি আর বৌদ্ধরা ছিল রাজনৈতিকভাবে নিগৃহীত। হিন্দু সমাজও ছিল বর্ণবাদের করাল গ্রাসে নিষ্পেষিত। বর্ণবাদী হিন্দু সমাজে ব্রাহ্মণগণই ছিল হর্তাকর্তা। নিম্নবর্ণের হিন্দুদের বিশেষ করে শূদ্রদের সামাজিক বা ধর্মীয় কোন অধিকারই ছিল না। এমনকি ধর্মগ্রন্থ পাঠ ও স্পর্শ করার অধিকার থেকেও তারা ছিল বঞ্চিত। নিম্নবর্ণের হিন্দুদের স্পর্শ করা কোন জিনিস উচ্চবর্ণের হিন্দুরা গ্রহণ করতো না। উচ্চবর্ণের হিন্দুরা নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সাথে বসে খাবার পর্যন্ত গ্রহণ করতো না। অন্যদিকে বৌদ্ধধর্মের অনুসারী সাধারণ বৌদ্ধরাও সেন রাজাদের দ্বারা নানাভাবে নির্যাতনের শিকারে পরিণত হয়েছিল। ফলে উভয় ধর্মের অনুসারী সাধারণ মানুষ সামাজিকভাবে নির্যাতিত বা অধঃপতিত অবস্থায় পতিত হয়েছিল। মোটকথা তৎকালীন বিদ্যমান সামাজিক অবস্থায় তাঁরা সকল প্রকার সামাজিক মর্যাদা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে নিঃস্ব ও নিঃশেষিত হয়ে পড়েছিল। এরূপ অবস্থায় উভয় ধর্মের সাধারণ মানুষ মুক্তির জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছিল । এ ঐতিহাসিক সামাজিক প্রেক্ষাপটে সুফিদের সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্ববোধের বাণী খুব সহজেই এ সমস্ত মানুষকে মুগ্ধ করে। ফলে তাঁরা দলে দলে ইসলামের পতাকাতলে সমবেত হতে শুরু করে। এতে শোষিত বঞ্চিত মানুষেরা ফিরে পায় তাদের সামাজিক মর্যাদা এবং অধিষ্ঠিত হয় সমাজের মর্যাদাপূর্ণ স্থানে। ফলশ্রুতিতে তৎকালীন সমাজ কাঠামোও নতুন রূপ পরিগ্রহ করে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায়, বাংলায় সুফিবাদী জীবনাদর্শ বা ইসলাম প্রচারিত হয়েছে একটি ঘুণেধরা বর্ণ বিভক্ত সমাজ কাঠামোতে। তৎকালীন বিদ্যমান সমাজের এরূপ সামাজিক প্রেক্ষাপটই সুফিবাদ প্রসারের পথকে সুপ্রশস্ত করে দিয়েছিল। একারণেই বলা হয় কোন প্রকার ভয়ভীতি বা জোরজবরদস্তির মাধ্যমে বাংলায় ইসলাম প্রচারিত হয়নি। বরং মানবিক আবেদনের কারণেই তা গৃহীত হয়েছে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87/