অথবা, বাঙালি দর্শন বিকাশে মনুসংহিতার ভূমিকা কীরূপ?
অথবা, বাঙালি দর্শনে মনুসংহিতার প্রভাব সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
অথবা, মনুসংহিতা কিভাবে বাঙালি দর্শন বিকাশে প্রভাব বিস্তার করেছে?
উত্তর।৷ ভূমিকা : বাঙালি দর্শন অতি প্রাচীন দর্শন। বাঙালি দর্শন বলতে বাঙালির ধ্যানধারণা,ভাবধারা, মতামত, সংস্কৃতি, ধর্ম, রাজনীতি প্রভৃতির সংমিশ্রণকে বুঝায়। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন বিষয় বাঙালি দর্শনের বিকাশে প্রভাব বিস্তার করেছে। এর মধ্যে প্রাচীন ও মধ্যযুগের সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থ উল্লেখযোগ্য। বাঙালি দর্শনের বিকাশে তেমনই একটি শাস্ত্রগ্রন্থ হলো মনুসংহিতা।
বাঙালি দর্শন বিকাশে মনুসংহিতার প্রভাব/ভূমিকা : বেদ-উপনিষদ এবং রামায়ণ-মহাভারত ও গীতা আলোচনাকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যান ঋষি মনু তার মনুসংহিতা গ্রন্থের মাধ্যমে। মনুসংহিতার অনেক বিষয় দ্বারা বাঙালি দর্শন প্রভাবিত হয়েছে।যথা:
১. মনুসংহিতার উপজীব্য বিষয় ও লক্ষ্য : মানুষের স্বরূপ, লক্ষ্য ও পরিণতি এবং মানবসমাজ ও রাজনীতি সম্পর্কিত আলোচনা মনুসংহিতার মূল উপজীব্য বিষয়। মনুসংহিতার মূল লক্ষ্য হলো- ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ নামক চতুর্বর্গের স্বরূপ ও তাদের লাভ করার প্রণালি আলোচনা করা।
২. মানব সমাজের শ্রেণিবিভাগ : মনুসংহিতায় মানবসমাজকে চতুবর্গে ভাগ করেন। এ চতুর্বর্গ আবার দ্বি জাতি ও একজাতি নামক দুটি ভাগে বিভক্ত। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যরা দ্বিজাতির অন্তর্ভুক্ত এবং শূদ্ররা এক জাতির অন্তর্ভুক্ত। মনুসংহিতানুসারে ব্রাহ্মণকে ব্রহ্মা মুখ থেকে, ক্ষত্রিয়কে বাহু থেকে, বৈশ্যকে উরু থেকে এবং শূদ্রকে পা থেকে সৃষ্টি করেছেন।
৩. কর্ম নির্ধারণ : মনুসংহিতায় বর্ণ অনুযায়ী কর্ম নির্ধারণ করা হয়েছে। মনুর মতে, ব্রাহ্মণের কাজ হলো অধ্যাপনা,অধ্যয়ন, যজন, যাজন, দান ও প্রতিগ্রহ; ক্ষত্রিয়ের কাজ প্রজা পালন, দেশরক্ষা, অধ্যয়ন; বৈশ্যের কাজ পশু পালন, দান,যজ্ঞ, অধ্যয়ন, বাণিজ্য এবং কৃষিকর্ম প্রভৃতি এবং শূদ্রের কাজ হলো আসূয়া ত্যাগ করে অপর তিন বর্ণের সেবা করা।
৪. আশ্রম ধর্ম : মনু আশ্রম ধর্ম সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, বর্ণধর্ম যেমন সমাজজীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে,আশ্রম ধর্মও তেমনি মানবজীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাঁর মতে, আশ্রমের সংখ্যা হলো চারটি। যথা : ব্রহ্মাচর্য, গার্হস্থ্য,বানপ্রস্থ এবং সন্ন্যাস।
৫. কর্ম এবং সত্য : চতুর্বর্ণের জন্য কর্ম নির্ধারণ করলেও ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের জন্য দশটি সাধারণ কর্মের কথা বলেন। এগুলো হলো- ধৃতি, ক্ষমা, ইন্দ্রিয় নিগ্রহ, আস্তয়, পবিত্রতা, সংযম, বুদ্ধি, বিদ্যা, সত্য এবং অক্রোধ প্রভৃতি। মনুসংহিতায় সত্যের লালন এবং অনুশীলনের প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। মনুসংহিতানুসারে সত্যের চেয়ে বড় কোনো ধর্ম নেই।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার আলোকে বলা যায়, মনুসংহিতায় মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক,ধর্মীয়সহ মানবজীবনের সকল দিক সম্পর্কিত আলোচনা রয়েছে। মনুসংহিতা বাঙালি হিন্দুসমাজে অনুসরণীয় ধর্মগ্রন্থ বলে বিবেচিত। মনুসংহিতার আলোচ্যবিষয় বাঙালি দর্শনের দার্শনিক চিন্তায় বিশেষ স্থান দখল করে আছে। বাঙালি দর্শনে মনুসংহিতার প্রভাব কোনভাবেই অস্বীকার করা যায় না।