সবার পরশে পবিত্র করা তীর্থ নীরে’ স্নাত না হলে সংস্কৃতিবান হওয়া যায় না”- মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ‘সংস্কৃতি কথা’ অবলম্বনে মন্তব্যটি বিচার।

অথবা, সংস্কৃতিবান হওয়ার উপায় কী? ‘সংস্কৃতি কথা’ প্রবন্ধানুসরণে প্রশ্নটির উত্তর দাও।
উত্তর৷ ভূমিকা :
পরিবেষ্টনের সাথে প্রীতির যোগে যে চিত্তের সমৃদ্ধি তাতেই সংস্কৃতির উৎপত্তি। পণ্ডিতেরা সংস্কৃতি নিয়ে নানা বিতর্ক করেন। এ বিতর্কের অবসান ঘুচিয়ে সুললিত ভাষায় সংস্কৃতি বিষয়ে সুস্পষ্ট যুক্তিসহ স্বচ্ছ ধারণা প্রদান করেছেন প্রগতিবাদী প্রাবন্ধিক মোতাহের হোসেন চৌধুরী তাঁর ‘সংস্কৃতি কথা’ প্রবন্ধে।
সংস্কৃতি : সংক্ষেপে প্রবন্ধকার কবিতার মতো বলেছেন, “সংস্কৃতি মানে সুন্দরভাবে, বিচিত্রভাবে, মহৎভাবে বাঁচা, প্রকৃতি সংসার ও মানব সংসারের মধ্যে অসংখ্য অনুভূতির শিকড় চালিয়ে দিয়ে বিচিত্র রস টেনে নিয়ে বাঁচা…., মহত্ত্বের জীবনদানে বাঁচা, … বিচিত্র দেশ ও বিচিত্র জাতির অন্তরঙ্গ সঙ্গী হয়ে বাঁচা, প্রচুরভাবে, গভীরভাবে বাঁচা। বিশ্বের বুকে বুক মিলিয়ে বাঁচা।” সংস্কৃতি সমাজতান্ত্রিক নয়, ব্যক্তিতান্ত্রিক। নিজে বাঁচা, নিজকে মহান, সুন্দর ও বিচিত্র করা সংস্কৃতির কাজ। তবে তা সমাজ নিরপেক্ষ নয়, ব্যক্তি সংস্কৃতির মাধ্যমে সংগতভাবে সমাজকে সংস্কৃতিবান করে তোলে। সমাজের দৈন্য দেখে সে অসুন্দরকে ক্ষমা করে না, সমাজের অধীন হয়েই সে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করে। সংস্কৃতি সমাজে বসবাসকারী দশজনের মধ্য থেকে ব্যক্তিকে স্বতন্ত্র করে তোলে এবং সমাজসেবার সুযোগ দেয়। সংস্কৃতি সত্য, সৌন্দর্য, ভালোবাসাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে শেখায়। নিজের ভেতরে স্বর্গ সৃষ্টি করে, অপরের সাথে ভাগ ও ভোগ করে চলতে শেখায়। সংস্কৃতির গোড়ার কথা মূল্যবোধ। তাই নীতি নয়, প্রীতিই বড়। অন্তরের মহিমাই বড়। দয়া-মায়া- স্নেহ তথা মহত্ত্বই পূজ্য। আপনার মধ্য লুকিয়ে থাকা অমৃতের সন্ধানই সংস্কৃতির কাজ। তাই সংস্কৃতির বন্ধনের অন্ত নেই। অসংখ্য সূক্ষ্ম ও মুক্তচিন্তার জনক হচ্ছে সংস্কৃতি। কোন ভয়ভীতি অথবা পুরস্কার সংস্কৃতিবানকে চালিত করে না। তার চালিকাশক্তি হচ্ছে ভালোবাসা।
ধর্ম ও সংস্কৃতি : আর সাধারণ লোক ধর্মকেই সংস্কৃতি জ্ঞান করে। ধর্ম মানে জীবনের নিয়ন্ত্রণ। ধর্ম ইহলোকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলতে এবং পরলোকে স্বর্গ পেতে শিক্ষা দেয়। এ কারণে যে কোন অন্যায় ও নিষ্ঠুর আচরণে তার কুণ্ঠা নেই। ধার্মিকের জীবন নিয়ন্ত্রিত হয়। ভয় আর পুরস্কারের লোভে। ধর্ম চায় মানুষকে পাপ ও পতন থেকে রক্ষা করতে। তাই ধর্ম বিকাশের পরিপন্থী, ইন্দ্রিয়সাধনার পরিপন্থী। নারীকে ভোগ্য বলে জ্ঞান করে বলেই ধর্মীয় জীবনে বৃদ্ধি নেই। কিন্তু সংস্কৃতি জীবনের মূল্যবোধ সম্পর্কে ধারণা দেয়। গোঁড়ামি থেকে মুক্তি দেয়া সংস্কৃতির কাজ । মুক্তির উপায় হচ্ছে নিজের অভ্রান্ততা সম্বন্ধে নিঃসন্ধিগ্ধতা। সৌন্দর্যই সংস্কৃতির লক্ষ্য।
সংস্কৃতিবান হওয়ার উপায় : নিজস্ব চিন্তাচেতনার বিকাশ না হলে সংস্কৃতিবান হওয়া যায় না। ধর্ম ও মতবাদ মানুষের স্বাতন্ত্র্য লুপ্ত করে বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, ব্যক্তির বিশেষত্বের পথ রোধ করে। ব্যক্তিকে সমাজের দশ জনের মত গড়ে উঠতে পরামর্শ দেয়; অনন্য জীবন তাদের চক্ষুশূল। মানুষ মূল্যবোধ শিক্ষা পায় সভ্যতার কাছ থেকে। সভ্যতাই মানুষকে সুন্দর ও প্রেমবান করে অন্যায় নিষ্ঠুরতাকে পরিহার করতে শেখায়। মানুষ সভ্য হলেই সংস্কৃতিবান হয়। অর্থাৎ সংস্কৃতিবান হওয়ার পূর্বশর্ত বা মাধ্যম হচ্ছে সভ্যতা। জ্ঞানের পথে দিক পরিবর্তনের প্রাগ্রসর হওয়ার অপর নাম প্রগতি। প্রগতির কারণেই মানবজীবন প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। প্রগতির সাথে সংস্কৃতির প্রেম ও সৌন্দর্য যুক্ত হলেই মানুষ হয়ে উঠে সংস্কৃতিবান।
সংস্কৃতির সাধনা : সংস্কৃতির সাধনা অর্থই ইন্দ্রিয়ের সাধনা। নারী হচ্ছে ইন্দ্রিয় সাধনার মাধ্যম। তাই নারীকে দূ রে না সরিয়ে তার সৌন্দর্যকে প্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করে, তাকে কেন্দ্র করে বিচিত্র সুকুমার বৃত্তির উন্মেষ ঘটালে মানুষ সংস্কৃতিবান হয়ে উঠতে পারে। কামের চেয়ে প্রেমকে বড় করে দেখার সাধনার মধ্য দিয়েই মানুষ সুন্দরভাবে, সহজভাবে বাঁচতে পারে। সেজন্য সংস্কৃতিবান মানুষ চায় নারীসঙ্গ। নারীই সংস্কৃতির চালিকাশক্তি। উন্নয়নের, সুন্দরের চাবিকাঠি।
কাম ও সংস্কৃতি : কোন কোন ধর্মে নারীকে বিষের নজরে দেখে। নারী তাদের কাছে কেবল কামের সামগ্রী ভোগের উপকরণ । নারীকে ঘিরে হৃদতন্ত্রীতে সূক্ষ্ম যে চৈতন্যের জন্ম দেয় ধার্মিক তার স্বাদ পাচ্ছে না। তাই নারীকে তারা স্থূল ভোগের সামগ্রী মনে করে। নারীকে ঘিরে যে যৌনতা, তাকে ধর্ম শাসনে রাখায় ধার্মিক যৌনতার উপরই আকৃষ্ট হয়। যৌন সম্ভোগকে অতিক্রম করে নারীর যে অপরূপ রূপ তার নাগাল তারা পায় না। যেহেতু ধর্ম মানেই হচ্ছে জীবনের নিয়ন্ত্রণ; কাজেই প্রেম দ্বারা কামকে নিয়ন্ত্রণের পথ ধর্ম সমর্থন করে না।
সংস্কৃতিবানের কর্তব্য : সংস্কৃতিবান ব্যক্তিমাত্রই সংস্কারমুক্ত। সংস্কারমুক্তি না ঘটলে সংস্কৃতিবান হওয়া যায় না। সংস্কৃতিবান লোকেরা সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে অন্যায় ও নিষ্ঠুরতাকে। একটা ব্যক্তিগত জীবনদর্শন বা স্বধর্ম সৃষ্টি করা তাদের কাজ। সংস্কৃতি একটা ব্যক্তিগত ধর্ম। ব্যক্তির ভিতরের আমিকে সুন্দর করে তোলাই সংস্কৃতিবানের কর্তব্য। কেবল সংস্কারমুক্ত হলেই সংস্কৃতিবানের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। সংস্কৃতির অনিবার্য শর্ত যে মূল্যবোধ তা অর্জন করাই সংস্কৃতিবানের প্রধান দায়িত্ব। মূল্যবোধহীন সংস্কৃতি অপসংস্কৃতির নামান্তর।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পেক্ষিতে বলা যায় যে, সংস্কৃতি মানে উন্নত জীবন সম্বন্ধে চেতনা, আনন্দ ও প্রেম সম্বন্ধে ধারণা। অন্যায় নিষ্ঠুরতাকে পরিহার, স্বধর্ম সৃষ্টি করা, সমাজে দশজনে এগারো হওয়া। নিজেকে স্বতন্ত্রভাবে গড়ে তোলা, বিকশিত করা। সত্য, সৌন্দর্য ও ভালোবাসাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসা। কিন্তু ধর্ম স্বধর্মের নীতি-আদর্শকে জীবনে প্রতিষ্ঠা করে বাঁচার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে । ধর্ম ও নীতির প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে সভ্যতা ও প্রগতির সংমিশ্রণে মানুষ মানুষ হয়ে উঠে। সংকীর্ণ জীবন থেকে বৃহত্তর জীবনের দিকে পা বাড়ানোর নিশ্চয়তা প্রদান করাই সংস্কৃতির কাজ। তাই লেখকের মন্তব্য- “সবার পরশে- পবিত্র করা তীর্থনীরে’ স্নাত না হলে সংস্কৃতিবান হওয়া যায় না।”

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%b8%e0%a6%82%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%95%e0%a7%83%e0%a6%a4%e0%a6%bf-%e0%a6%95%e0%a6%a5%e0%a6%be-%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%ac%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a7-%e0%a6%ae%e0%a7%8b%e0%a6%a4/