বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ১৯৭১ সালে সংঘটিত একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, যা পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) জনগণের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ফলাফল। এই যুদ্ধের পটভূমি বোঝার জন্য আমাদের কিছু ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ এবং সামাজিক গতিশীলতা বিশ্লেষণ করতে হবে।
১. ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভাজনের পর থেকে গড়ে ওঠে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তান গঠিত হয় পশ্চিম পাকিস্তান (বর্তমান পাকিস্তান) ও পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) নিয়ে। এই দুই অংশের মধ্যে প্রায় ১৬০০ কিলোমিটার ভৌগোলিক দূরত্ব ছিল, এবং ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনধারার পার্থক্য ছিল উল্লেখযোগ্য। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করে, যা ক্রমশ স্বাধীনতার দাবিকে জোরালো করে।
২. ভাষা আন্দোলন (১৯৪৮-১৯৫২)
স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমির একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ ছিল ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে যে উর্দু হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এটি পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠীর জন্য অগ্রহণযোগ্য ছিল, কারণ বাংলা ছিল তাদের মাতৃভাষা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষা। এর প্রতিবাদে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ও সাধারণ মানুষের বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে বেশ কয়েকজন শহিদ হন। এই ঘটনা বাঙালি জাতীয়তাবাদের জাগরণ ঘটায় এবং স্বাধীনতার বীজ বপন করে। পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালে বাংলা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
৩. অর্থনৈতিক বৈষম্য
পূর্ব পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় অনেক বেশি অবহেলিত ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের পাট রপ্তানি থেকে প্রাপ্ত বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে ব্যয় হতো। পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প, অবকাঠামো ও শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ ছিল নগণ্য। এই অর্থনৈতিক শোষণ বাঙালিদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে।
৪. রাজনৈতিক বঞ্চনা
পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে কেন্দ্রীভূত। বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও সরকারি ও সামরিক প্রশাসনে তাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল নামমাত্র। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার পর এই বৈষম্য আরও প্রকট হয়। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ছয় দফা দাবি উত্থাপন করে, যা পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানায়। এই ছয় দফা বাঙালি জাতীয়তাবাদের একটি মাইলফলক হয়ে ওঠে।
৫. ১৯৭০ সালের নির্বাচন ও সংকট
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়। এর ফলে রাজনৈতিক সংকট তীব্র হয়। শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং পাকিস্তান সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে দমনপীড়ন শুরু করে।
৬. অপারেশন সার্চলাইট ও যুদ্ধের সূচনা
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী “অপারেশন সার্চলাইট” নামে বাঙালিদের বিরুদ্ধে নৃশংস দমন অভিযান শুরু করে। এই অভিযানে হাজার হাজার মানুষ হত্যা করা হয় এবং লাখ লাখ মানুষ ভারতে পালিয়ে যায়। এই ঘটনা বাঙালিদের সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করে। ২৬ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, এবং মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়।
৭. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জাগরণ
বাঙালি জাতীয়তাবাদ শুধু রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি ছিল বাঙালি সংস্কৃতি, ভাষা ও পরিচয়ের জাগরণ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশের মতো কবি-সাহিত্যিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলন বাঙালিদের মধ্যে আত্মপরিচয়ের চেতনা জাগিয়েছিল।
৮. আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায়। ভারত শরণার্থীদের আশ্রয় দেয় এবং মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ ও সহায়তা প্রদান করে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়, যা বাংলাদেশের বিজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে, এবং বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
উপসংহার
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি ছিল দীর্ঘদিনের বৈষম্য, শোষণ ও সাংস্কৃতিক জাগরণের ফলাফল। ভাষা আন্দোলন, অর্থনৈতিক শোষণ, রাজনৈতিক বঞ্চনা এবং সামরিক দমনপীড়ন বাঙালিদের স্বাধীনতার জন্য একত্রিত করে। এই যুদ্ধ শুধু একটি ভৌগোলিক স্বাধীনতার লড়াই নয়, বরং বাঙালি জাতির পরিচয় ও আত্মমর্যাদার সংগ্রাম ছিল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি অত্যন্ত বিস্তৃত এবং এর মূল নিহিত ছিল ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যমূলক আচরণের মধ্যে। নিচে প্রধান প্রধান পটভূমিগুলো আলোচনা করা হলো:
১. দ্বিখণ্ডিত রাষ্ট্র পাকিস্তানের সৃষ্টি ও দূরত্ব (১৯৪৭):
- ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ভৌগোলিকভাবে দুই হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দূরত্বে অবস্থিত দুটি অংশ নিয়ে গঠিত হয় এই রাষ্ট্র—পূর্ব পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ) ও পশ্চিম পাকিস্তান।
- এই দুই অঞ্চলের মানুষের ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন, কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মই ছিল একমাত্র মিলের জায়গা।
২. ভাষা আন্দোলন (১৯৪৮-১৯৫২):
- পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তীব্র প্রতিবাদ জানায়।
- ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ আরও অনেকে শহীদ হন। এই ঘটনা বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটায় এবং স্বাধীনতার বীজ বপন করে।
৩. রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য:
- জন্মলগ্ন থেকেই পূর্ব পাকিস্তান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক সর্বক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় বৈষম্যের শিকার হয়।
- অর্থনৈতিক শোষণ: পূর্ব পাকিস্তান থেকে বেশি রাজস্ব আয় হলেও উন্নয়নের বেশিরভাগ বাজেট পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা হতো। পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ ব্যবহার করে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন নিশ্চিত করা হয়।
- রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বঞ্চনা: পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ক্ষেত্র সংকুচিত করা হয় এবং ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতা দখল করেন।
৪. ৬ দফা আন্দোলন (১৯৬৬):
- ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি পেশ করেন।
- ছয় দফা ছিল মূলত স্বায়ত্তশাসনের দাবি, যা বাঙালির ‘মুক্তির সনদ’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে এবং স্বাধীনতার আন্দোলনকে এক নতুন মাত্রা দান করে।
৫. উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান (১৯৬৯):
- সামরিক শাসন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছাত্রদের ১১ দফা ও বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার ভিত্তিতে ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানে এক ব্যাপক গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়।
- এই গণঅভ্যুত্থানের ফলে সামরিক শাসক আইয়ুব খানের পতন ঘটে।
৬. ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন ও ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি:
- ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদেও সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
- জনগণের ম্যান্ডেট সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী নির্বাচিত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বিলম্ব ও ষড়যন্ত্র শুরু করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল যেকোনোভাবে ক্ষমতা বাঙালিদের হাতে যেতে না দেওয়া।
৭. অসহযোগ আন্দোলন ও ৭ মার্চের ভাষণ (১৯৭১):
- ক্ষমতা হস্তান্তরে সামরিক শাসকগোষ্ঠীর টালবাহানার প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন।
- ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তিনি জনগণকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান এবং ঘোষণা করেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” এই ভাষণটি ছিল স্বাধীনতার চূড়ান্ত প্রস্তুতির একটি দিকনির্দেশনা।
৮. ২৫ মার্চের গণহত্যা ও স্বাধীনতার ঘোষণা:
- পাকিস্তানের শাসকবর্গ আলোচনার ভান করে সময়ক্ষেপণ করতে থাকে। এরপর ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর “অপারেশন সার্চলাইট” নামে এক বর্বরোচিত গণহত্যা শুরু করে।
- ২৫ মার্চের কালো রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের আগে তিনি ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
এই সকল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য এবং ধারাবাহিক আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি রচিত হয় এবং চূড়ান্তভাবে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ১৯৭১ সালে সংঘটিত হয়,但其 পটভূমি রচিত হয়েছিল দীর্ঘদিন ধরে। নিম্নে ধারাবাহিকভাবে এর পটভূমি আলোচনা করা হলো:
১. ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমি:
- ভাষা আন্দোলন (১৯৫২): বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ রোপিত হয় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পরেই উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেওয়া হলে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য পূর্ব বাংলার জনগণ প্রতিবাদে সোচ্চার হয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত ও অন্যান্য শহিদদের রক্তের বিনিময়ে বাংলা ভাষা তার মর্যাদা অর্জন করে। এই আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি তৈরি করে।
২. রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পটভূমি:
- পাকিস্তানের জন্ম ও বৈষম্যের সূত্রপাত (১৯৪৭): ১৯৪৭ সালে ধর্মীয় ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পূর্ব বাংলা পূর্ব পাকিস্তান নামে পাকিস্তানের একটি অংশে পরিণত হয়। কিন্তু শুরুতেই ভূ-রাজনৈতিক ব্যবধান এবং শাসকগোষ্ঠীর মনোভাবে বৈষম্য প্রকট হয়ে ওঠে।
- রাজনৈতিক বৈষম্য: ক্ষমতা ও প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। সামরিক ও বেসামরিক উচ্চপদগুলোতে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের উপস্থিতি ছিল নগণ্য।
- অর্থনৈতিক বৈষম্য: পূর্ব পাকিস্তান ছিল পাকিস্তানের জনসংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এবং পাট রপ্তানি করে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ আয় করত। কিন্তু এই অর্থ বিনিয়োগ হতো প্রধানত পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে। পূর্ব পাকিস্তান পরিণত হয় পশ্চিম পাকিস্তানের একটি কাঁচামালের উৎস ও পণ্য বিক্রির বাজারে।
- ৬-দফা আন্দোলন (১৯৬৬): শেখ মুজিবুর রহমান প্রদত্ত এই ৬-দফা দাবিনামা ছিল মূলত পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার রূপরেখা। এটি বাঙালিদনের ম্যাগনাকার্টা নামে পরিচিতি লাভ করে এবং স্বাধিকার আন্দোলনকে স্বতঃস্ফূর্ত ও সংগঠিত রূপ দেয়।
- আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা (১৯৬৮): শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জন বাঙালি সামরিক ও বেসামরিক অফিসারকে ভারতের সাথে ষড়যন্ত্রের মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। এটি পূর্ব বাংলায় ব্যাপক বিক্ষোভের সৃষ্টি করে।
- ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান: আগরতলা মামলা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তির দাবিতে সারা পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। এর চাপে সরকার আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি লাভ করেন।
- ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচন: ঐতিহাসিক এই নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলে পরিণত হয়। জনগণের এই ভোট ছিল ৬-দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য স্বতঃস্ফূর্ত ম্যান্ডেট।
৩. স্বাধীনতা যুদ্ধের সরাসরি সূচনা:
- অসহযোগ আন্দোলন (মার্চ ১৯৭১): সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হওয়া সত্ত্বেও শেখ মুজিবুর রহমানকে সরকার গঠন করতে না দিয়ে আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করা হয়। এর প্রতিবাদে ২ মার্চ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। фактиভাবে সমগ্র প্রদেশের প্রশাসনিক কার্যক্রম তাঁর নির্দেশে চলতে থাকে।
- ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ: ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লাখো জনতার সামনে শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তিনি বলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” তিনি বাঙালি জাতিকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন চালানোর এবং শত্রুর মোকাবিলায় প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দেন। এই ভাষণই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার অঘোষিত ঘোষণা।
- অপারেশন সার্চলাইট (২৫শে মার্চ, ১৯৭১): সামরিক সমাধানের লক্ষ্যে পাকিস্তানের তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানে “অপারেশন সার্চলাইট” নামে একটি পরিকল্পিত গণহত্যা শুরু করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ লাইনসহ বিভিন্ন স্থানে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর তারা নির্মম হামলা চালায়। এই রাতেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে।
- স্বাধীনতার ঘোষণা (২৬শে মার্চ, ১৯৭১): ২৫শে মার্চ মধ্যরাতেই (অর্থাৎ ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে) শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তারপর তাকে গ্রেপ্তার করা হলেও এই ঘোষণা ওয়ারলেসের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ২৬শে মার্চ চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।
সারাংশ: ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে দীর্ঘ ২৩ বছরের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য, নিপীড়ন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির সচেতন প্রতিরোধই ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি তৈরি করেছিল। ১৯৭০-এর নির্বাচনে জনগণের রায়কে অস্বীকার করা এবং পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের গণহত্যাই ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের চূড়ান্ত এবং непосредতিক কারণ।