🙏 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবতাবাদ: এক গভীর পর্যালোচনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবতাবাদ হলো তাঁর দর্শন ও সাহিত্যের প্রধান ভিত্তি। একে বিশ্ব মানবতাবাদ (Universal Humanism) বলা হয়, যেখানে মানুষই হলো সবকিছুর কেন্দ্রে। তাঁর মানবতাবাদের মূল ভাবনাগুলো নিচে আলোচনা করা হলো:
- মানুষের মর্যাদা ও মূল্যবোধ:
- রবীন্দ্রনাথ মানুষের অন্তর্নিহিত মূল্যবোধ ও মর্যাদার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব এবং মানুষের মধ্যেই ঈশ্বর বা দিব্যসত্তা বিরাজমান। তাঁর মতে, মানুষকে অপমান করা বা ছোট করা মানে স্বয়ং ঈশ্বরকে অপমান করা।
- তিনি মানুষের চিন্তাশক্তি, কর্মক্ষমতা ও জ্ঞানের শক্তিকে গুরুত্ব দিতেন, যা মানুষকে রক্ষা করে এবং এগিয়ে নিয়ে যায়।
- মানব ধর্ম বা ধর্মের ধারণা:
- রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদ কোনো চিরায়ত বা প্রথাগত ধর্ম নয়, বরং এটি হলো “মানুষের ধর্ম” (The Religion of Man)। এই ধর্ম মানুষকে ভালোবাসতে শেখায় এবং মানুষের সেবা করাকেই ঈশ্বরের সেবা বলে মনে করে।
- তিনি সামাজিক বৈষম্য, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। তাঁর কাছে মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, ন্যায়বোধ ও কল্যাণসাধনই সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম।
- বিশ্ব ঐক্যবোধ ও অখণ্ড মানবসত্তা:
- কবি বিশ্বমানবতার ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর মানবতাবাদ কোনো নির্দিষ্ট দেশ বা সীমানার মধ্যে আবদ্ধ নয়। তিনি মনে করতেন, দেশ-কাল-নির্বিশেষে মানুষ তার সাধনার মাধ্যমে এক অখণ্ড মানবসত্তা গড়ে তোলে।
- তাঁর রচনায় জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষের মিলন ও সম্প্রীতির সুর ধ্বনিত হয়েছে। তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উপরও জোর দিয়েছেন।
- স্বাধীনতা ও মুক্তি:
- রবীন্দ্রনাথের দর্শনে মানুষের পরিপূর্ণ মুক্তি ও স্বাধীনতার ধারণাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি মনে করতেন, মানুষ তার সীমাহীন স্বাধীনতা ও শূন্যতার মধ্য দিয়ে নিজের অস্তিত্বকে উপলব্ধি করে।
- তাঁর সাহিত্যকর্মে তিনি নারীদের মর্যাদা ও মুক্তির পক্ষে কলম ধরেছেন, পুরুষ-শাসিত সমাজে নারীর মুক্তিপথের বাধাগুলো দূর করতে চেয়েছেন।
- শ্রেয় ও প্রেয়-এর ধারণা:
- তিনি মানুষের স্বভাবে বর্তমান ‘শ্রেয়’ (যা কল্যাণকর) এবং ‘প্রেয়’ (যা প্রিয়) -এর মধ্যে পার্থক্য করেছেন। তাঁর মতে, প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি শ্রেয়কে গ্রহণ করেন, যা মানুষকে শ্রেষ্ঠত্বের দিকে চালিত করে।
এককথায় বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবতাবাদ হলো মানুষের প্রতি গভীর বিশ্বাস, মানুষের অভ্যন্তরীণ শক্তির ওপর আস্থা এবং মানুষের মুক্তি ও কল্যাণের জন্য আজীবন সাধনা।


