বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের প্রতিবন্ধকতাসমূহ আলোচনা কর

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অনেকগুলো কাঠামোগত এবং সামাজিক প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান। যদিও প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলের প্রধান নারী হওয়া সত্ত্বেও, তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারণী স্তর পর্যন্ত নারীদের অংশগ্রহণ এখনও আশানুরূপ নয়।

নিম্নে প্রধান প্রতিবন্ধকতাসমূহ আলোচনা করা হলো:


১. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতা

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের প্রধান বাধা হলো গভীরভাবে প্রোথিত পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা এবং রক্ষণশীল সামাজিক মূল্যবোধ

  • পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা (Patriarchy):
    • পারিবারিক ও রাজনৈতিক উভয় কাঠামোর পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব নারীকে অধস্তন হিসেবে দেখে এবং তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, ক্ষমতা বা সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণের অধিকারকে স্বীকার করে না।
    • পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ নারীর ক্ষমতায়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে কাজ করে, যা নারীকে কেবল গৃহস্থালি কাজের জন্য উপযুক্ত মনে করে।
  • রক্ষণশীল লিঙ্গভিত্তিক ভূমিকা ও প্রথা:
    • নারীদের জন্য পর্দা প্রথা বা ঘরের বাইরে কাজ না করার মতো রক্ষণশীল সামাজিক প্রত্যাশা এখনও অনেক পরিবার ও সমাজে বিদ্যমান, যা নারীদের জনজীবনে, বিশেষ করে রাজনীতিতে, সক্রিয় অংশগ্রহণকে সীমিত করে।
    • নারীকে পরিবারের প্রাথমিক তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যার ফলে রাজনীতি বা জনসম্পৃক্ততার জন্য প্রয়োজনীয় সময় দেওয়া তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে।
  • নিরাপত্তাহীনতা ও হয়রানি:
    • রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর জন্য নিরাপত্তা একটি বড় উদ্বেগের বিষয়। রাজনীতিতে নারীদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত না থাকায় অনেক মেধাবী নারী রাজনীতিতে আসতে বা টিকে থাকতে দ্বিধা বোধ করে।
    • নারীদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য হয়রানি এবং পুরুষ সহকর্মীদের কাছ থেকে অসহযোগিতার শিকার হতে হয়।

২. রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবন্ধকতা

রাজনৈতিক দলগুলোর কাঠামো এবং স্থানীয় সরকারের দুর্বল আইনগত অবস্থান নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণে বাধা সৃষ্টি করে।

  • রাজনৈতিক দলে নারীর দুর্বল অবস্থান:
    • রাজনৈতিক দলগুলোর নীতিনির্ধারণী পর্যায় বা কেন্দ্রীয় কমিটিতে নারীদের প্রয়োজনীয় উপস্থিতি নেই। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী রাজনৈতিক দলের সব স্তরের কমিটিতে ৩৩% নারী নেতৃত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্য থাকলেও বেশিরভাগ দলই তা পূরণ করতে পারেনি।
    • দলগুলো সাধারণত যোগ্যতা বা বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতার চেয়ে প্রার্থীর জেতার সম্ভাবনা (Winnability), অর্থপ্রভাবকে বেশি গুরুত্ব দেয়, যেখানে নারীরা প্রায়শই পিছিয়ে পড়েন।
  • আইনি ও কাঠামোগত দুর্বলতা (বিশেষ করে স্থানীয় সরকারে):
    • ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভায় সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্যরা প্রায়শই পুরুষ সহকর্মীদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত স্থান বা সম্পদ বরাদ্দ পান না।
    • সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত নারী প্রতিনিধিদের ভূমিকা, ক্ষমতা বা দায়িত্ব আইনে সুস্পষ্টভাবে সুনির্দিষ্ট করা হয়নি। এর ফলে স্থানীয় উন্নয়নে তাদের কার্যকর ভূমিকা রাখার সুযোগ সীমিত হয়ে যায়।
  • সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বঞ্চনা:
    • পুরুষদের কর্তৃত্ব এবং পুরুষতান্ত্রিক আচরণের কারণে নারীরা প্রায়শই কর্মক্ষেত্রে বা স্থানীয় কাউন্সিলে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়েন।

৩. অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা

অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকাও রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ সীমিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।

  • অর্থনৈতিক সম্পদের অভাব:
    • রাজনৈতিক প্রচার-প্রচারণা চালানো বা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য প্রচুর তহবিল প্রয়োজন।
    • আইনগত বৈষম্য বা সামাজিক প্রথার কারণে নারীদের আর্থিক সম্পদ ও সম্পত্তির ওপর সীমিত প্রবেশাধিকার বা নিয়ন্ত্রণ থাকে, যা তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্বাধীনভাবে অর্থ ব্যয় করার ক্ষমতাকে সীমিত করে।
  • দারিদ্র্য:
    • দরিদ্রদের মধ্যে নারীরা আরও দরিদ্র অবস্থানে থাকেন। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হওয়ায় রাজনীতিতে সফল হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্রভাব, সামাজিক যোগাযোগ বা লজিস্টিক সমর্থন তৈরি করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।