ভূমিকা
আদমশুমারি বা বর্তমানে প্রচলিত “জনশুমারি” একটি দেশের জনসংখ্যা এবং তাদের আর্থ-সামাজিক ও জনতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের একটি প্রক্রিয়া। এটি একটি দেশের পরিকল্পনা প্রণয়ন, উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন এবং নীতি নির্ধারণের জন্য অপরিহার্য একটি ভিত্তি। প্রতি দশ বছর অন্তর এই বিশাল কার্যক্রম পরিচালিত হয়, যা একটি দেশের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে এবং ভবিষ্যতের গতিপথ নির্ধারণে সহায়ক হয়। জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী, জনশুমারি হলো একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোনো জনগোষ্ঠী বা দেশের জনসংখ্যা গণনার সামগ্রিক প্রক্রিয়া, যেখানে তথ্য সংগ্রহ, একত্রীকরণ এবং জনমিতিতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক তথ্যাদি প্রকাশ করা হয়।
আদমশুমারির বৈশিষ্ট্য
আদমশুমারির কিছু সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা এটিকে অন্যান্য পরিসংখ্যানিক কার্যক্রম থেকে স্বতন্ত্র করে তোলে। এই বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:
১. প্রতিটি ব্যক্তির তথ্য গণনা (Individual Enumeration): আদমশুমারিতে একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে বসবাসকারী প্রতিটি ব্যক্তিকেই গণনা করা হয়। এতে কোনো ব্যক্তি বাদ পড়ে না, ফলে প্রাপ্ত তথ্য অত্যন্ত নির্ভুল ও নির্ভরযোগ্য হয়।
২. একই সময়ে সারাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা (Simultaneity): জনশুমারির কার্যক্রম একই নির্দিষ্ট সময়ে সারা দেশে পরিচালিত হয়। এর ফলে জনসংখ্যার গতিবিধি বা স্থানান্তর জনশুমারির ফলাফলের উপর প্রভাব ফেলে না এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ের জনসংখ্যার একটি স্থির চিত্র পাওয়া যায়।
৩. একটি চিহ্নিত এলাকায় সামষ্টিক গণনা (Defined Territory): আদমশুমারি একটি সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে পরিচালিত হয়। এটি একটি দেশ, প্রদেশ, জেলা, বা এমনকি ছোট গ্রাম বা মহল্লা পর্যন্ত হতে পারে। এর ফলে আঞ্চলিক জনসংখ্যার সঠিক চিত্র পাওয়া যায়।
৪. নির্দিষ্ট সময় পর পর পুনরাবৃত্তি (Periodicity): সাধারণত প্রতি দশ বছর অন্তর আদমশুমারি পরিচালিত হয়। এই নির্দিষ্ট সময় ব্যবধান জনসংখ্যার পরিবর্তন, বৃদ্ধি বা হ্রাস এবং অন্যান্য আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের প্রবণতা বোঝার জন্য সহায়ক হয়।
৫. সরাসরি তথ্য সংগ্রহ (Direct Enumeration): আদমশুমারিতে গণনাকারীরা সরাসরি প্রতিটি পরিবার বা ব্যক্তির কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন। এতে মৌখিক প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে বয়স, লিঙ্গ, বৈবাহিক অবস্থা, শিক্ষা, পেশা, ধর্ম, জন্মস্থান, কর্মসংস্থান, আবাসন ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য নেওয়া হয়। আধুনিককালে ডিজিটাল পদ্ধতিতেও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
৬. ব্যাপকতা (Universality): এটি একটি অত্যন্ত ব্যাপক কার্যক্রম, যা দেশের প্রতিটি অঞ্চল, প্রতিটি পরিবার এবং প্রতিটি ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করে। এর মাধ্যমে সমাজের সকল স্তরের তথ্য উঠে আসে।
৭. আইনগত ভিত্তি (Legal Basis): আদমশুমারি সাধারণত একটি নির্দিষ্ট আইনের অধীনে পরিচালিত হয়। যেমন বাংলাদেশে “পরিসংখ্যান আইন-২০১৩” অনুযায়ী জনশুমারি পরিচালিত হয়। এই আইনগত ভিত্তি তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করে।
৮. বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক ও জনতাত্ত্বিক তথ্য সংগ্রহ (Socio-economic and Demographic Data): শুধুমাত্র জনসংখ্যার সংখ্যাই নয়, আদমশুমারিতে লিঙ্গ, বয়স, শিক্ষার স্তর, বৈবাহিক অবস্থা, ধর্ম, পেশা, আয়ের উৎস, বাসস্থান, প্রতিবন্ধিতা, প্রবাসে অবস্থানকারী জনসংখ্যা, রেমিট্যান্স ইত্যাদি বিষয়েও তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এই তথ্যগুলো দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা মূল্যায়নে গুরুত্বপূর্ণ।
৯. প্রশাসনের পরিকল্পনা ও নীতিনির্ধারণে ব্যবহার (Planning and Policy Making): আদমশুমারির মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য সরকার, পরিকল্পনাবিদ, গবেষক এবং বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার জন্য অত্যন্ত মূল্যবান। এই তথ্য ব্যবহার করে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, আবাসন, অবকাঠামো উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়ে পরিকল্পনা ও নীতি প্রণয়ন করা হয়।
উপসংহার
আদমশুমারি বা জনশুমারি একটি জাতির প্রতিচ্ছবি। এটি শুধুমাত্র সংখ্যার হিসাব নয়, বরং একটি দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান, সামাজিক কাঠামো, অর্থনৈতিক প্রবণতা এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে প্রতিফলিত করে। এই কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রাপ্ত সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্য একটি দেশের সুষম ও টেকসই উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। আধুনিক ডিজিটাল পদ্ধতিতে পরিচালিত জনশুমারি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আরও সুদূরপ্রসারী এবং কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়ক হবে, যা একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।