ভূমিকা:
রাজনৈতিক সংস্কৃতি একটি সমাজের মানুষের রাজনৈতিক বিশ্বাস, মূল্যবোধ, রীতিনীতি এবং আচরণের সমষ্টি। এটি একটি দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, প্রতিষ্ঠান এবং জনগণের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ধরনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশ একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সংস্কৃতি গঠনের পথে অগ্রসর হয়েছে। তবে, এই পথ মসৃণ ছিল না। বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, সামাজিক কাঠামো এবং রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চাকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। এই আলোচনায় বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চার স্বরূপ এবং এর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরা হবে।
আলোচনা:
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো ব্যক্তি ও গোষ্ঠীভিত্তিক রাজনীতি। এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর আদর্শিক ভিত্তি দুর্বল এবং প্রায়শই ব্যক্তি বিশেষ বা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর আনুগত্যের ওপর নির্ভরশীল। ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে মুষ্টিমেয় কিছু নেতার হাতে এবং দলীয় পর্যায়ে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের অভাব দেখা যায়।
দ্বিতীয়ত, সহিংসতা ও অসহিষ্ণুতা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি উদ্বেগজনক দিক। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও বিদ্বেষ প্রায়শই সংঘর্ষ ও হানাহানির জন্ম দেয়। নির্বাচনকালীন সময়ে এবং রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সহিংসতা একটি সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে।
তৃতীয়ত, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি রাজনৈতিক সংস্কৃতির গভীরে প্রোথিত। ক্ষমতার অপব্যবহার, সরকারি তহবিলের অপচয় এবং আত্মীয়-স্বজনের প্রতি পক্ষপাতিত্ব একটি স্বাভাবিক চিত্র। এর ফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং জনগণের আস্থা অর্জন কঠিন হয়ে পড়ে।
চতুর্থত, আইনের শাসনের দুর্বলতা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি বড় সমস্যা। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে আইনের প্রয়োগে বৈষম্য দেখা যায়। শক্তিশালী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অন্যায় অনেক সময় বিচারের ঊর্ধ্বে থেকে যায়, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করে।
পঞ্চমত, নাগরিক সমাজের দুর্বল ভূমিকা একটি কার্যকর রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশে অন্তরায়। যদিও কিছু ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে, তবে সামগ্রিকভাবে তাদের প্রভাব সীমিত। রাজনৈতিক দলগুলোর আধিপত্য এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে নাগরিক সমাজের স্বাধীন ও শক্তিশালী বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।
তবে, এর পাশাপাশি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে। গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা এদেশের মানুষের মধ্যে প্রবল। দীর্ঘ স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং ভোটাধিকারের জন্য জনগণের আগ্রহ প্রমাণ করে যে তারা একটি গণতান্ত্রিক ও অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা চায়।
এছাড়াও, সংবিধানের প্রতি মৌখিক আনুগত্য প্রায় সকল রাজনৈতিক দলের মধ্যেই দেখা যায়। যদিও বাস্তবে এর প্রতিফলন কম, তবুও সাংবিধানিক কাঠামোর বাইরে গিয়ে ক্ষমতা দখলের প্রবণতা তুলনামূলকভাবে কম।
উপসংহার:
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চা একটি জটিল এবং বহুমাত্রিক প্রক্রিয়া। একদিকে যেমন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীভিত্তিক রাজনীতি, সহিংসতা, দুর্নীতি এবং আইনের শাসনের দুর্বলতার মতো নেতিবাচক দিক বিদ্যমান, তেমনি অন্যদিকে জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা এবং সংবিধানের প্রতি মৌখিক আনুগত্যের মতো ইতিবাচক দিকও পরিলক্ষিত হয়। একটি সুস্থ ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের চর্চা, সহনশীলতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের উন্নয়ন, আইনের শাসনের প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি দমন এবং একটি শক্তিশালী নাগরিক সমাজের উত্থান। নীতিনির্ধারক, রাজনৈতিক দল এবং জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে, যা একটি স্থিতিশীল, সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের পথ প্রশস্ত করবে।