কৃষ্ণকুমারী নাটকের মূলভাব লেখক-মাইকেল মধুসূদন দত্ত

অনার্স বাংলা ২য় বর্ষ

বিষয়ঃবাংলা নাটক ১

টপিক-কৃষ্ণকুমারী নাটকের মূলভাব

লেখক-মাইকেল মধুসূদন দত্ত

কৃষ্ণকুমারী (১৮৬১) মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ট্রাজেডি নাটক। নাটকটির কাহিনী উইলিয়াম টডের ‘রাজস্থান’ নামক গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত হয়েছে। এই নাটকের উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলো হলো: কৃষ্ণকুমারী, মদনিকা, বিলাসবতী, ভীমসিংহ, জগৎসিংহ, মানসিংহ, ধনদাস প্রমূখ। নাটকটি ১৮৬০ সালে রচিত হলেও প্রকাশিত হয় ১৮৬১ সালে। মাইকেল মধুসূদন দত্তের কৃষ্ণকুমারী নাটকে নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেন কৃষ্ণকুমারী নিজে। নাটকে কাহিনী প্রবাহিত হয় মদনিকা এবং ধনদাস চরিত্রের মাধ্যমে। নাটকের মূল বিষয়বস্তু হল কৃষ্ণকুমারীর নিজের জীবন বিসর্জন। কৃষ্ণকুমারী রূপে গুণে অনন্য। তার একটি চিত্রপট দেখে জগৎসিংহ তাকে বিবাহ করার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে। ধনদাসের মাধ্যমে ভীমসিংহের কাছে রাজা জগৎসিংহ কৃষ্ণার বিবাহের পয়গাম পাঠান। ধনদাস এই নাটকে একটি হীন চরিত্র সে টাকার জন্য সব করতে পারে। নাটকের মদনিকা চরিত্র হল বিলাসবতীর সখী। ধনদাস হল জগৎসিংহের নারী সংগ্রহকা। মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট বাঙালি কবি ও নাট্যকার। তাকে বাংলার নবজাগরণ সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব গণ্য করা হয়।

ব্রিটিশ ভারতের যশোর জেলার এক সম্ভ্রান্ত কায়স্থ বংশে জন্ম হলেও মধুসূদন যৌবনে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে মাইকেল মধুসূদন নাম গ্রহণ করেন এবং পাশ্চাত্য সাহিত্যের দুর্নিবার আকর্ষণবশত ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন। জীবনের দ্বিতীয় পর্বে মধুসূদন আকৃষ্ট হন নিজের মাতৃভাষার প্রতি। এই সময়েই তিনি বাংলায় নাটক, প্রহসন ও কাব্যরচনা করতে শুরু করেন।

মাইকেল মধুসূদন বাংলা ভাষায় সনেট ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক। তার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি অমিত্রাক্ষর ছন্দে রামায়ণের উপাখ্যান অবলম্বনে রচিত মেঘনাদবধ কাব্য নামক মহাকাব্য। মাইকেলের ব্যক্তিগত জীবন ছিল নাটকীয় এবং বেদনাঘন। মাত্র ৪৯ বছর বয়সে কলকাতায় মৃত্যু হয় এই মহাকবির
আলোচনা: কৃষ্ণকুমারী মধুসূদন এর ইতিহাস আশ্রিত ট্র্যাজেডি নাটক। এবং বাংলায় প্রথম মৌলিক নাটক। মধু প্রতিভার পূর্ণরূপ প্রকাশ পেয়েছিলো কৃষ্ণকুমারীতে। মধুসূদন খুব মনোযোগের সাথে টডের ইতিহাস অনুসরণ করেছেন। নাটক টি পাশ্চাত্য আদর্শে রচিত। তিনি মূলত কবি। তার মতে গদ্যে মানুষের অনুভূতি প্রকাশ হয় ঠিকই, কিন্তু নর-নারীর আবেগ ও গভীর অনুভূতি প্রকাশ একমাত্র কাব্য দ্বারা সম্ভব।

কেশবচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়ের অনুরোধে তিনি টড বর্নিত রাজপুতগনের ইতিহাস থেকে এই নাটকের কাহিনী গ্রহণ করে, নাটকের প্রয়োজনে ইতিহাস কিছুটা অদল বদল করে কোন ঘটনাকে বিকৃত না করে রচনা করেন। নাটকটি অনেক বেশি বিশ্বস্ততার সাথে ইতিহাসকে অনুসরণ করেছে।

নাটকে কাহিনী শুরু রাণা ভীমসিংহ ১৭৭৮-১৮২৭ খ্রিষ্টাব্দে পর্যন্ত মেবারের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সম্রাট রূপে তাকে যেভাবে ভাগ্য বিরূপের শিকার হতে হয়েছে তেমনি হত হয়েছে পিতা হিসেবেও। এটাই নাটকের মূল।

শেলরাজ ভীমসিংহ। ভীমসিংহের বংশীয় গৌরব ছিলো অনেক আগে থেকেই। কিন্তু মহারাষ্ট্র তার উপর এমন ভাবে চেপে বসে আছে। তাতে তার অর্থবিত্ত ও শক্তিতে সে দূর্বল হয়। ভীমসিংহের একমাত্র যুবতী কন্যা কৃষ্ণকুমারী। সে অতিশয় রূপবতী।

উদয়পুরের রাজা জগৎসিংহের অনুচর ধনদাস টাকার লোভে তার কাছে কৃষ্ণকুমারীর ছবি বিক্রি করে, বিশ সহস্র মুদ্রা সংগ্রহ করে। এবং রাজাকে কৃষ্ণার দিকে দাবিত করে। রাজা পক্ষ থেকে ধনদাস ভীমসিংহের কাছে বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে যায়। কিন্তু জগৎসিংহ এর রক্ষিতা বিলাসবতী তাকে ভালবাসে। সে কৃষ্ণাকে বিয়ে করবে শুনে কেঁদে বুক ভাসায়। এ কথা জানতে পারে তার সখী মদনিকা। এবং সে কৌশল করে মরুদেশীয় রাজা মানসিংহের কাছে পত্র পাঠায় এই বলে, কৃষ্ণা মানসিংহকে ভালবাসে। জয়সিংহ জোর করে কৃষ্ণাকে বিয়ে করতে চায়। মানসিংহ যেন তার হাত হতে কৃষ্ণাকে রক্ষা করে। সে ছদ্মবেশে হাজির হয় কৃষ্ণার কাছে। এবং নিজেকে মানসিংহের দূতী বলে পরিচয় দেয়। সে তাকে এক পুরুষের চিত্র দেখিয়ে বলে এটা মানসিংহ। মানসিংহ তাকে বিয়ে করতে চায়। ছবি দেখে কৃষ্ণা পছন্দ করে।

এদিকে রাজা ভীমসিংহ ধনদাস এর কথা শুনে রাজি হয়, জগৎসিংহ ও কৃষ্ণকুমারীর বিয়ে দিতে। তখন মরুদেশীয় রাজা হতে খবর আসে। রাজা এটাও জানতে পারেন কৃষ্ণা মানসিংহতে অনুরক্তা। এটা জেনে তিনি ধনদাস কে ফেরত পাঠান।

এতে জগৎসিংহ রাগান্বিত হয়ে আবার খবর পাঠান যদি কৃষ্ণাকে তার সাথে বিয়ে দেওয়া না হয়, তবে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে। আবার মানসিংহও এই হুমকি দেয়। ভীমসিংহ বুঝতে পারেন, তার মেয়েকে যে রাজার কাছেই বিয়ে দেন না কেন অন্য রাজা যুদ্ধ ঘোষণা করবেন। এমন অবস্থায় যুদ্ধ ঘোষণা দিলে তিনি তা রুখে দাড়াবার শক্তি সঞ্চয় করতে পারবেন না। কেন না তার রাজ্যভান্ডার রিক্ত। তিনি এক অসহায় রাজা এবং পিতা হয়ে মুহ্যমান হন। কি হবে এর পরিনতি।

কৃষ্ণকুমারী নাটকের কাহিনী ইতিহাসের হলেও লেখক তাকে রোমান্টিক ট্র্যাজেডি রূপে দিয়েছেন।

চরিত্র হিসেবে ভীমসিংহ কেন্দ্রীয় চরিত্র। জগৎসিংহ এখানে বেহায়াপনায় মত্ত। তবে সেটা ধনদাসের কারণে। মন্ত্রীর সাথে কাজ করার থেকে মেয়ে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করেন। বিলাসবতী কে ধনদাস ই বারবনিতা বানায়। মদনিকা সখীর কষ্ট সহ্য করতে পারে নি। কৃষ্ণকুমারী পিতার অনুগত কন্যা। তাছাড়াও বলেন্দ্রসিংহ, সত্যদাস, মহিষী অহল্যা অনতম চরিত্র।