অথবা, জাতীয় আয় কি অর্থনৈতিক কল্যাণের একটি উত্তম নির্দেশক?
অথবা, GNP এর বৃদ্ধি কি অর্থনৈতিক কল্যাণ নির্দেশ করে?
উত্তর : ভূমিকা : অধ্যাপক পিজ এর মতে অর্থনৈতিক কল্যাণ সামাজিক কল্যাণের একটি অংশ যা মোটামোটিভাবে অর্থের মানদণ্ডে পরিমাপ করা যায়। কিন্তু অর্থনৈতিক কল্যাণ এমন একটি ধারণা যা সমাজের অ-অর্থনৈতিক কল্যাণের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক কল্যাণকে কেবল বস্তুগত দৃষ্টিকোন হতে পৃথকভাবে মূল্যায়ন করা যায় না। আয়ের পদ্ধতি ব্যয়ের প্রকৃতি কাজের পরিবেশ সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা প্রভৃতি বিষয়গুলো অর্থনৈতিক কল্যাণকে নিয়ন্ত্রণ করে।
অর্থনীতিবিদ পিশু, জন স্টুয়ার্ট মিল প্রমুখ আয়ের সুষম বণ্টন সাপেক্ষে জাতীয় আয়কে অর্থনৈতিক কল্যাণের নির্দেশক হিসেবে গণ্য করেন।
সাধারণভাবে এরূপ ধারণা করা হয়ে থাকে যে (GNP) বা জাতীয় আয় বৃদ্ধি পেলে সমাজের মানুষের কল্যাণ বাড়ে। এ বক্তব্যের স্বপক্ষে যেসব যুক্তি দেখানো হয় তাহল:
(১) GNP বা জাতীয় আয় বাড়লে সমাজের মোট বস্তুগত উৎপাদন বাড়ে। এর ফলে মানুষের ভোগ ও কল্যাণ বাড়ে।
(২) GNP বা জাতীয় আয় বৃদ্ধি পেলে মানুষের জীবন যাত্রার মান বৃদ্ধি পায়। তাই কল্যাণ বৃদ্ধি পায়।
(৩) GNP বা জাতীয় আয় বাড়লে বিনিয়োগ ও কর্মস্থান বাড়ে। এর ফলে দারিদ্র্যতা কমে। সমাজের দারিদ্র্যতা কমলে কল্যাণ বাড়ে। কিন্তু জাতীয় আয় বাড়লেই মানুষের কল্যাণ বাড়ে, একথা সহজেই মেনে নেয়া যায় না। K. Boulding, Peter Kennedy, K. Stewart প্রমুখ আধুনিক অর্থনীতিগণ মনে করেন। জাতীয় আয় বাড়লে মানুষের কল্যাণ বাড়ে না। অথবা জাতীয় আয়কে অর্থনৈতিক কল্যাণের উত্তম সূচক মনে করেন না।
(১) GNP বা জাতীয় আয় পরিমাপের একমাত্র উপাদান নয় বরং অনেক উপাদানের একটি মাত্র। কাজেই অন্যান্য উপাদান অনুকূলে না থাকলে শুধু GNP বা জাতীয় আয় বাড়লেই বাড়ে না।
(২) GNP বাড়ার সাথে সাথে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ না হলে (যেমন- অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা বাসস্থান) কল্যাণ বাড়ে না।
(৩) দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভাল না থাকলে জাতীয় আয় বাড়লেও মানুষের কল্যাণ বাড়ে না বরং কমে।
(৪) আয়ের অসম বণ্টন হলে জাতীয় আয় বাড়লেও কল্যাণ বাড়ে না। অধিকাংশ আয় মুষ্টিময় লোকের হাতে থাকলে এবং অধিকাংশ লোকের হাতে স্বল্প আয় থাকলে কল্যাণ হ্রাস দায়। কাজেই কল্যাণ শুধু GNP এর উপর নয়- বরং তার বণ্টন ব্যবস্থার উপরও নির্ভর করে।
(৫) জাতীয় আয় বাড়ার সাথে সমাজের মৌলিক অবকাঠামোর অনুকূল পরিবর্তন না হলে (শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ) কল্যাণ বাড়ে না। একটি বাস্তব উদাহরণ দেয়া যাক।
ইউরোপের এমন অনেক দেশ রয়েছে যাদের মাথা পিছু জাতীয় আয় বা GNP মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের তুলনায় কম। যেমন- স্পেনের মাথা পিছু INP কুয়েতের চেয়ে কম। কিন্তু স্পেনের মানুষ কুয়েতের মানুষের চেয়ে অধিক কল্যাণকর অবস্থার জীবন যাপন করে। কাজেই কোন দেশের GNP কিংবা মাথা পিছু GNP বাড়লেই সে দেশের কল্যাণ বাড়লে- একথা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কল্যাণের সাথে সম্পর্কিত অপরাপর বিষয়সমূহ অনুকূলে থাকলেই কেবল জাতীয় আয় বাড়লে কল্যাণ বাড়তে পারার জন্য নয়।
সুতরাং জাতীয় আয় বা GNP কল্যাণ পরিমাপের কোন ভাল সূচক নয়। বাংলাদেশের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। জাতীয় আয় বা GNP বাড়লে কিংবা প্রবৃদ্ধির হার বাড়লেই এদেশের
সকল মানুষের কল্যাণ বাড়বে এমনটি বলা যায় না।আয় বণ্টনের অসমতা, মৌলিক চাহিদার ঘাটতি, প্রতিকূল রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ অনুন্নত অবকাঠামে ইত্যাদি উন্নয়ন পরিপন্থী বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতিকে জাতীয় আয় বা GNP বাড়লেও সকল মানুষের কল্যাণ বাড়তে পারে না।জাতীয় আয় বাড়লে মুষ্টিমেয় কিছু লোকের সম্পদ ও কল্যাণ বাড়ে- সকলের নয়। কাজেই বাংলাদেশের বাস্তবতায় জাতীয় আয় বা GNP এর বৃদ্ধি কল্যাণ পরিমাপের কোনো ভাল সূচক নয়।