উত্তর: ভূমিকা: একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে যে সব সমস্যা বাধার সৃষ্টি করে সে গুলিকে সে দেশের মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যা বলে। দীর্ঘ সময়ের ঔপনিবেশিক ও বিজাতীয় শাসনের ফলে এদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুষ্ঠু অবকাঠামো ও ধারা সৃষ্টি হয়নি। ফলে এদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নানা রূপ মৌলিক সমস্যা বিদ্যমান। নিয়ে বাংলাদেশের মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো আলোচনা করা হলোঃ
১. অনুন্নত কৃষি ব্যবস্থাঃ বাংলাদেশের প্রধান মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যা হলো অনুন্নত কৃষি ব্যবস্থা। কৃষি নির্ভর দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা সেকেলে, ত্রুটিপূর্ণ ও নিম্ন-উৎপাদনশীলতা। প্রাচীন চাষ পদ্ধতি, ত্রুটিপূর্ণ ভূমি স্বত্ব ব্যবস্থা, স্বল্পবিনিয়োগ, গ্রাকৃতিক দূর্যোগ প্রভৃতি কারণে এদেশের কৃষি ব্যবস্থা অনুন্নত ও অবিজ্ঞানসম্মত।
২. শিল্পের অনগ্রসরতাঃ সুষ্ঠু শিল্পনীতির অভাব, শিল্পপুজির স্বল্পতা, ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা, আধুনিক প্রযুক্তি বিদ্যার অভাব প্রভৃতি অনেক কারণে বাংলাদেশের শিল্পখাত উন্নত ও সম্প্রসারিত হয় নাই। জাতীয় উৎপাদনে শিল্পখাতের অবদান অতি নগণ্য।
৩. জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চ হারঃ বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অনেক স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় বেশি। এ বিপুল জনসংখ্যা (প্রায় ১৬ কোটি) দেশের সীমিত সম্পদের উপর চাপ সৃষ্টি করে ও উন্নয়নের গতিকে ব্যাহত করে।
৪. খাদ্য সমস্যা ঃ বাংলাদেশের কৃষি খাতের নিম্ন উৎপাদনশীলতার জন্য খাদ্য ঘাটতি একটি স্থায়ী সমস্যা। এখানে বাৎসরিক খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ২০ লক্ষ টন। এরূপ খাদ্য সমস্যার ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার উপর চাপ পড়ে এবং উন্নয়ন কর্মকাও ব্যাহত হয়।
৫. মূলধনের অভাবঃ বাংলাদেশে মূলধনের অভাব খুব বেশি। আমাদের দেশের অধিকাংশ জনগণ গরীব এবং তাদের সঞ্চয় সামর্থ্য নেই। সঞ্চয় সামর্থ্যের অভাবে প্রয়োজনীয় মূলধন গড়ে উঠে না। মূলধনের অভাবে কৃষি ও শিল্পের উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে।
৬. বেকার সমস্যাঃ জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় বাংলাদেশে বিনিয়োগ অল্প। এজন্য অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত কর্মসুযোগ সৃষ্টি হয় না। ফলে এদেশে মোট জনশক্তির প্রায় ৩০ ভাগ বেকার এবং কৃষি ক্ষেত্রে প্রায় ১০ ভাগ ছদ্ম বেকার।
৭. শিক্ষার অভাবঃ শিক্ষা হলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবিকাঠি। বর্তমানে, বাংলাদেশে শিক্ষিতের হার ৬৫ ভাগ। এত। কম শিক্ষিতের হার নিয়ে কোন দেশেই অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করা সম্ভব নয়। শিক্ষার অভাবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি পথকে বাধাগ্রস্থ করছে।
৮. অনুন্নত অর্থনেতিক অবকাঠামো: বাংলাদেশে উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক অবকাঠামো অনুন্নত ও দুর্বল। রাস্তাঘাট, ব্রিজ, বিদ্যুৎ পানি সরবরাহ সেচ, বাঁধ নির্মাণ, ব্যাংক ইত্যাদির সুযোগ-সুবিধা সীমিত হওয়ায় উন্নয়ন
কার্যক্রম ব্যাহত হয়।
৯. প্রাকৃতিক ও মানব সম্পদের অপূর্ণব্যবহারঃ বিনিয়োগের স্বল্পতা ও কারিগরি দক্ষতার অভাবে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক ও মানব সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার সম্ভব হয় না। ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায় না।।
১০. উদ্যোক্তার অভাবঃ বাংলাদেশে পণ্য সামগ্রি বেশির ভাগই কৃষি থেকে প্রাপ্ত। আর এ জাতীয় পণ্যের মূলে-র উত্থান-পতন হয় বেশি। পণ্যের মূল্য উত্থান-পতন হয় এমন সব ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা অর্থ বিনিয়োগ করতে ঝুঁকি মনে করে। ফলে উদ্যোক্তার অভাবে উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে।
১১. প্রতিকূল বৈদেশিক বাণিজ্যঃ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার প্রয়োজনে বাংলাদেশ বিপুল পরিমাণ মূলধন দ্রব্য ও ভোগ্য পণ্য আমদানি করে। কিন্তু এখানকার-রপ্তানি বাণিজ্য এখনও সীমিত ও অবিকেন্দ্রীভূত। ফলে বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অব্যাহতভাবে ঘাটতি বিরাজ করে।
১২. স্বল্প মাথা পিছু আয় ও নিম্নজীবন যাত্রার মান:অর্থনৈতিক উন্নয়নের নিম্ন হার এবং স্বল্প উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশে মাথা পিছু আয় খুব কম। ফলে ব্যাপক সংখ্যা গরিষ্ঠ লোক নিম্ন জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত। শতকরা ৬০ জন লোক ‘চরম দারিদ্র্য সীমার নিচে জীবনযাপন করে।
১৩. বৈদেশিক মুদ্রার অভাবঃ অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে যথেষ্ট পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয় না। বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে।
১৪. কাঁচামাল উৎপাদনকারী দেশঃ বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। এদেশে যা কিছু উৎপাদন করা হয় তা বেশির ভাগই প্রাথমিক পণ্য। প্রাথমিক পণ্য উৎপাদনই বাংলাদেশকে অনুন্নতির বেড়া জালে আঁকড়ে রাখে।
১৫. আন্তর্জাতিক প্রভাব: বাংলাদেশ জন্মলগ্ন থেকেই বিদেশের উপর নির্ভরশীল হয়ে আসছে। এদেশ উন্নত দেশগুলোর পুতুল হিসেবে কাজ করছে। সরকার পরিবর্তনের সাথে পরাশক্তির বলয় পরিবর্তন হচ্ছে। এতে করে উন্নত দেশের করুনার উপর দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। মোট কথা বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক প্রভাব বলয় থেকে মুক্ত হতে পারছে না।
১৬. অনুন্নত যাতায়াত ও পরিবহন ব্যবস্থা: বাংলাদেশের পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই অনুন্নত। পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অনুন্নতির কারণে কৃষি শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্যের বিকাশ ঘটছে না।
১৭. দ্বৈত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা দ্বৈত ধরনের। একদিকে গ্রামীণ অর্থনীতি, অন্যদিরে শহরভিত্তিক অর্থনীতি। উন্নয়নের ও উৎপাদনের ক্ষেত্র হলো গ্রাম অথচ জনসাধারণ শহরমুখী স্থানান্তর হচ্ছে। ফলে উন্নয়নের ক্ষেত্রে দক্ষতা ও কর্মনৈপুণ্যতা হ্রাস পাচ্ছে। শহরে শিক্ষিত, অর্ধ-শিক্ষিত বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে।
১৮. ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতিঃ আমাদের অপর একটি অর্থনৈতিক সমস্যা হচ্ছে ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি। ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতির ফলেও আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে।
১৯. সম্পদের অপ্রতুলতাঃ বাংলাদেশে জনসংখ্যার তুলনায় প্রাকৃতিক সম্পদ অপ্রতুল। এ কারণে আমাদের শিল্প উন্নয়ন ব্যাহত হয়।
২০. মহিলাদের কর্মসংস্থানের অভাবঃ বাংলাদেশের মহিলাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ একেবারেই অপ্রতুল।ফলশ্রুতিতে মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক পরনির্ভরশীল জীবনযাপন করে। ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হয়।
২১. ত্রুটিযুক্ত পরিকল্পনা: বাংলাদেশে যে সমস্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে তা সবই কম-বেশি ত্রুটিযুক্ত। কোন পরিকল্পনাই লক্ষ্যসীমায় পৌছাতে পারেনি। ফলে প্রতিটি পরিকল্পনায় ব্যর্থ হচ্ছে কর্ম পদ্ধতি।
২২. প্রাকৃতিক দুর্যোগ: কৃষিই অর্থনীতির মেরুদন্ড। কিন্তু বাংলাদেশের প্রবল বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, খরা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দূর্যোগের অহরহ আবির্ভাব আমাদের কৃষির মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেয়। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
২৩. বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতাঃ বাংলাদেশের উন্নয়ন কাঠামো পুরোটাই বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীল। এ সাহায্য অনিশ্চিত হলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পিছিয়ে পড়ে।
২৪. অনুন্নত সামাজিক পরিবেশ: বাংলাদেশে অশিক্ষা, কুশিক্ষা, কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামী, ফতোয়াবাজি ইত্যাদি কারণে সামাজিক পরিবেশ উন্নত নয়। এতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জনসেবামূলক কাজকর্ম বাধাগ্রস্থ হয়।
২৫. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা: বাংলাদেশে বিদ্যমান অব্যাহত রাজনৈতিক অস্থিরতা, আন্দোলন ও অশান্তির জন্য শিল্প কারখানায় উৎপাদন এবং অন্যান্য কাজকর্ম বিঘ্নিত হচ্ছে।
উপসংহার: উপরে বাংলাদেশের অর্থনীতির যে মৌলিক সমস্যা তুলে ধরা হলো তার দ্বারা উন্নয়নের মুখোশ না খুলে বরং বন্ধ্যাত্বর সৃষ্টি করে। উন্নয়ন বৃদ্ধিকারি শক্তি উন্নয়ন বিনষ্টকারীর শক্তির চেয়ে বেশি প্রবল হতে পারছে না।