অথবা, অর্থনৈতিক মৌলিক সমস্যাসমূহ সমাধানের দিক নির্দেশনাগুলো তুলে ধর।
উত্তর : ভূমিকা : অর্থনীতি যেহেতু সমগ্র মানব সমাজের কল্যাণে নিয়োজিত একটি প্রগতিশীল শাস্ত্র, সেহেতু বিভিন্ন সমাজের সকল স্তরে অর্থনীতির সমস্যাসমূহ কম-বেশি পরিলক্ষিত হয়। অর্থনৈতিক সমস্যার প্রকৃতি বিভিন্ন সমাজে একরূপ হলেও এ সকল সমস্যা সমাধানের পদ্ধতি সমাজভেদে ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির হয়। যেমন-সমাজে কিভাবে অর্থনৈতিক সমস্যাসমূহের সমাধান করা হবে তা নির্ভর করে উক্ত সমাজে বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর।
বর্তমান পৃথিবীর বিদ্যমান অর্থনেতিক ব্যবস্থাসমূহ নিম্নরূপঃ
১. ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাঃ ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী অর্থনীতি এমন এক ব্যবস্থা যেখানে সরকারি হস্তক্ষেপ ব্যতীত ব্যক্তি ও সমাজ উৎপাদন বণ্টন এবং ভোগের ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করে। এ অর্থনীতির মূল বৈশিষ্ট্য হলো ব্যক্তিগত উদ্যোগের অবাধ স্বাধীনতা। উৎপাদন ও বণ্টনের ক্ষেত্রে এ ব্যবস্থায় সরকারি হস্তক্ষেপ থাকে না। পরোক্ষভাবে সরকার কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করে। এ ব্যবস্থায় উৎপাদনের উপকরণসমূহ তাই ব্যক্তিগত মালিকানায় নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। সুতরাং উৎপাদনের উপকরণসমূহকে কিভাবে কাজে লাগিয়ে সর্বাধিক কল্যাণ নিশ্চিত করা যাবে তা ব্যক্তি উদ্যোক্তাগণ নির্ধারণ করতে পারেন। ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিতে সমাজে বিদ্যমান উৎপাদন, বণ্টন, বিনিময় ও ভোগ সংক্রান্ত যাবতীয় সমস্যা সমাধানের জন্য বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। অর্থাৎ কোন একটি সমাজে কি কি দ্রব্য ও সেবা উৎপাদন করা হবে, কি পরিমাণ উৎপাদন করা হবে, কিভাবে উৎপাদন করা হবে, কিভাবে বণ্টন করা হবে প্রভৃতি বিষয়ের সিদ্ধান্ত বেসরকারি পর্যায়েই গৃহীত হয়। যেহেতু মুনাফা অর্জন এ ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য থাকে তাই প্রত্যেক ক্ষেত্রে উৎপাদনের উপকরণসমূহ এমনভাবে নিয়োগ করা হয় যেন প্রতিটি ক্ষেত্রে মুনাফা সর্বাধিক হয়।
২. সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। ‘সমাজতন্ত্র; হল এমন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে উৎপাদনের উপকরণসমূহের উপর কোন ব্যক্তিগত মালিকানা থাকে না। সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় উৎপাদনের উপকরণের উপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় সাধারণত একটি কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষ থাকে।
সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার ন্যায় ব্যক্তিগত মুনাফার প্রতি লক্ষ্য রেখে উৎপাদন কার্য পরিচালনা করা হয় না; বরং সামাজিক কল্যাণের প্রতি লক্ষ্য রেখেই উৎপাদন, বণ্টন ও ভোগব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত করা হয়। সুতরাং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের পদ্ধতি ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে মূলগতভাবে পৃথক। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে সমাজের যাবতীয় অর্থনৈতিক সমস্যাবলি সমাধানের চেষ্টা করা হয়। অর্থনৈতিক সমস্যাবলি সমাধানে সমাজতান্ত্রিক প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে ধনতান্ত্রিক প্রচেষ্টার তুলনায় অনেক বেশি ফলপ্রসূ। বস্তুত, সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহ তুলনামূলকভাবে অত্যন্ত কম সময়ের মধ্যে তাদের জনগণের অর্থনৈতিক সমস্যাবলি সমাধান করতে সক্ষম হয়েছে। এ জন্য বর্তমানে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
৩. মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থাঃ ‘মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থা’ বা মিশ্র অর্থনীতি’ বলতে এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বুঝায় যেখানে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ পাশাপাশি বিরাজ করে। মিশ্র অর্থনীতিকে ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে। সামঞ্জস্য বিধান করা হয়। মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সরকারি বা রাষ্ট্রীয় খাতের অস্তিত্ব সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার সুবিধাসমূহ অর্জনে সহায়তা করে। আবার সরকারি খাতের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের অস্তিত্ব ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় সুবিধাসমূহ ভোগ করতে সাহায্য করে।
মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় উৎপাদন, বণ্টন, ভোগ প্রভৃতি অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য একদিকে যেমন ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার ন্যায় ‘স্বয়ংক্রিয় মূল্য ব্যবস্থার’ উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করা হয় না। মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতির সংমিশ্রণ ঘটেছে। বর্তমানে পৃথিবীর অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশে মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে বিভিন্ন সমস্যা সমাধান ও দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
উপসংহার: বিভিন্ন অর্থব্যবস্থার তুলনামূলক আলোচনায় একথা স্পষ্ট যে, মানুষের মৌলিক সমস্যার সমাধানের মানব রচিত মতবাদ ধনতন্ত্র সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে ইসলামী অর্থব্যবস্থায় সফলতা ও কার্যকারিতা স্পষ্ট। সুতরাং একমাত্র ইসলামী সমাজ ব্যবস্থাই মানুষের উল্লেখিত মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান দিতে সক্ষম।