রাজা ও রাজতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ কর।

রকেট সাজেশন
রকেট সাজেশন

অথবা, ব্রিটেনের প্রচলিত শাসনব্যবস্থায় রাজা এবং রাজতন্ত্রের সম্পর্ক কীরূপ, তা আলোচনা কর।
অথবা, রাজা ও রাজতন্ত্রের মধ্যে বিভেদ গুলো উল্লেখ কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার শীর্ষস্থানে অবস্থিত ব্রিটেনে বর্তমানে রাজতন্ত্র বিদ্যমান, যেখানে বংশানুক্রমিকভাবে রাজা বা রাণী রাজত্ব করেন। ব্রিটেনের এই প্রচলিত রাজতন্ত্র এবং রাজা বা রাণীর অবস্থানকে আপাতদৃষ্টিতে একই মনে হলেও বাস্তবে তা নয়। কেননা, রাজতন্ত্র হল একটি প্রতিষ্ঠান এবং রাজা বা রাণী হলেন একজন ব্যক্তি। পূর্বের স্বেচ্ছাচারী রাজতন্ত্রের যুগে সকল ক্ষমতা ব্যক্তিগতভাবে রাজার হাতে কেন্দ্রীভূত ছিল এবং বাজাই ছিলেন সকল ক্ষমতার উৎস। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে ধীরে ধীরে রাজার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে এবং ব্রিটেনের রাজতন্ত্র বর্তমানে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রে পরিণত হয়েছে। তাই রাজতন্ত্র এবং রাজা বা রাণীর সম্পর্ক সম্পর্কিত আলোচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

রাজা এবং রাজতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য: সাধারণভাবে ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থায় রাজা বা রাণী এবং রাজতন্ত্র শব্দ দু’টিকে সমার্থক মনে হলেও বাস্তবে তা নয় বরং উভয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য বিদ্যমান, গ্লাডস্টোন উভয়ের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন, “ব্রিটেনে রাজা এবং রাজতন্ত্র বা রাজশক্তির মধ্যকার পার্থক্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।” নিম্নে উভয়ের পার্থক্য আলোচনা করা হল।

১. অবস্থানগত পার্থক্য: রাজতন্ত্র হল একটি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু রাজা বা রাণী হলেন একজন ব্যক্তি। অর্থাৎ রাজতন্ত্র বলতে বুঝায় রাজার পদকে এবং রাজতন্ত্রের ব্যবহারকারী বিশেষ একজন ব্যক্তি হলেন রাজা বা রাণী।

২. হায়িত্বের ক্ষেত্রে পার্থক্য: স্থায়িত্বের ক্ষেত্রেও উভয়ের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। কারণ রাজা যখন রাজত্ব চালাতে অসমর্থ হন, তখন তিনি ক্ষমতা ছেড়ে দেন। আবার রাজার মৃত্যুর সাথে সাথে ব্যক্তি বাজার পতন ঘটে। কিন্তু ব্যক্তি রাজার মৃত্যু হলেও রাজতন্ত্রের বিলোপ ঘটে না। নিয়মানুযায়ী আরেকজন ব্যক্তি রাজা বা রাণীর পদে অধিষ্ঠিত হয়।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, রাজার পদ স্থায়ী নয় কিন্তু রাজত্ব স্থায়ী।

৩. ক্ষমতাগত পার্থক্য: রাজতন্ত্রের হাতে সকল ক্ষমতা ন্যস্ত থাকলেও ব্যক্তি রাজা প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতাহীন। কেননা কেবিনেট তার নামে সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকেন। তাই রাজতন্ত্র বা প্রাতিষ্ঠানিক রাজার ক্ষমতা থাকলেও ব্যক্তি রাজার কোন ক্ষমতা নেই।

৪. কর্তৃত্বগত পার্থক্য: সময়ের প্রয়োজনে পার্লামেন্টের সম্মতিতে রাজতন্ত্রের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কেননা রাজতর সর্বদাই পার্লামেন্টের পরামর্শ অনুযায়ী কর্তৃত্ব প্রয়োগ করে থাকে। কিন্তু রাজার ক্ষমতা পার্লামেন্ট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও আবন্ধ।

৫. ধারণাগত পার্থক্য: রাজতন্ত্র হল একটি আইনগত ধারণা। রাজার বিশেষাধিকারের সাথে সরকারের ব্যাপক ক্ষমতার যোগফলের প্রতীক হিসেবে ব্রিটেনের রাজতন্ত্রকে বিবেচনা করা হয়। অন্যদিকে, রাজা হলেন একজন ব্যক্তিমাত্র। মন্ত্রিদের কাজকর্মের জন্য রাজা বা রাণী ব্যক্তিগতভাবে দায়ী থাকেন না। মূলত তার নামে দেশের মন্ত্রিসভা সরকারি ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকে।

৬. মুনরো এবং এয়ার্স্ট (Munro & Ayearst) এর মতবাদ: রাজা এবং রাজতন্ত্রের পার্থক্য করতে গিয়ে মুনরো এবং এয়ার্স্ট বলেন, রাজার হাত হতে রাজশক্তিকে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমেই ব্রিটিশ সংবিধানের বিকাশ ঘটেছে। তাছাড়া রাজার ক্ষমতা ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কর্তৃক আবদ্ধ এবং তার মর্যাদা অনেক পরিবর্তিত হয়েছে।

৭. কার্টার, রেনী এবং হার্জ এর মতামত: রাজতন্ত্র একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান। সরকারের পরিবর্তন ঘটলেও রাজতন্ত্র অব্যাহত থাকে। রাজার গুণাবলি যাই হোক না কেন, প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাজতন্ত্র এখন প্রকৃত মর্যাদা ও গৌরবের অধিকারী। তাদের মতে, রাজা ও রাজতন্ত্রের পার্থক্য ‘ব্রিটেনের সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ নীতি। ব্রিটেনের রাজা বা রাণী এবং রাজতন্ত্রের মধ্যে উপর্যুক্ত পার্থক্য থাকার কারণে সেখানে কতকগুলো ধারণা বা প্রবচন গড়ে উঠেছে। নিম্নে বিস্তারিত ‘আলোচনা করা হল।

ক. রাজার মৃত্যু হয়েছে, রাজা দীর্ঘজীবী হোন অথবা রাজার মৃত্যু নেই: দৃশ্যত প্রবাদ দু’টি অবাস্তব মনে হলেও প্রকৃত বিচারে প্রবাদ দু’টি গভীরভাবে তাৎপর্যপূর্ণ এবং অর্থবহ। মানুষ মাত্রই মরণশীল। তাই ব্যক্তিগতভাবে কোন রাজাই অমর নয়। কিন্তু ব্যক্তি রাজার মৃত্যু বা তার শাসনামলের অবসান ঘটলেও রাজতন্ত্রের ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ণ হয় না। কারণ একজন রাজার মৃত্যু ঘটলে সাথে সাথে উত্তরাধিকারীকে জাঁকজমক সহকারে অভিষেক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে রাজপদে বসানো হয়। এ সম্পর্কে মুনরো বলেন, “The crown is an artificial or juristic person, it is not incarnate and it never dies.”
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, ব্যক্তি রাজার মৃত্যু হলেও প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাজতন্ত্র স্থায়ী।

খ. রাজা কোন অন্যায় করতে পারে না: ব্রিটেনে প্রচলিত এ ধারণাকে বিভ্রান্তিকর মনে হলেও যুগ যুগ ধরে তা টিকে রয়েছে। কারণ এ ধারণা ব্যক্তি রাজা সম্পর্কে নয় বরং এ ধারণা প্রাতিষ্ঠানিক রাজা বা রাজতন্ত্র সম্পর্কে। কেননা প্রথাগতভাবে সরকারি কাজের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রীকেই জবাবদিহি করতে হয়, রাজাকে নয়। ফলে আদালতে রাজার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আনা যায় না। সিডনি লো তাই রাজাকে কাজের সুবিধার জন্য একটি অনুমান হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, রাজা তো কোন অন্যায় করতে পারেন না, এমনকি তিনি অন্যায় চিন্তাও করতে পারে না।”

গ. রাজা রাজত্ব করেন কিন্তু শাসন করেন না তত্ত্বগতভাবে ব্রিটেনের সকল ক্ষমতার উৎস হচ্ছে রাজতন্ত্র, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ভিন্ন চিত্র পরিলক্ষিত হয়। কেননা বর্তমান পার্লামেন্টারীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় রাজা নিয়মতান্ত্রিক শাসকে পরিণত হয়েছে এবং রাজার নামে কেবিনেট, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে ব্রিটেনের শাসনকার্য পরিচালিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ সরকারি কাজ রাজার নামে পরিচালিত হলেও, প্রকৃত ক্ষমতা প্রয়োগ করে মন্ত্রিসভা। তাই বলা হয়ে থাকে, রাজা রাজত্ব করেন, কিন্তু শাসন করেন না।

ব্রিটেনের রাজা এবং রাজতন্ত্রের বর্তমান অবস্থা: ব্রিটেনে রাজা বা রাজতন্ত্রের অনেক পরে কেবিনেট, পার্লামেন্ট, বিচারবিভাগ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি হলেও বর্তমানে এসকল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অত্যধিক। দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা সৃষ্টির সাথে সাথে ব্রিটেনে রাজার ক্ষমতা সংকুচিত করে রাজতন্ত্রের নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে। আবার এ রাজতন্ত্র পার্লামেন্টের অধীন হওয়ার কারণে রাজার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে পার্লামেন্ট এবং মন্ত্রিসভার পরামর্শ অনুযায়ী রাজতন্ত্র ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকে। প্রাতিষ্ঠানিক রাজা পার্লামেন্ট ও কেবিনেটের অধীনস্থ সংস্থায় পরিণত হওয়ায় ব্যক্তিগত শাসন থেকে প্রাতিষ্ঠানিক শাসনে পরিবর্তিত হয়েছে। আর এ রূপান্তর ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থাকে
গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, রাজা বা রাণী এবং বাজতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও উভয়ই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। রাজা বা রাণী ছাড়া যেমন রাজতন্ত্র চলতে পারে না, তেমনি রাজত্ব ব্যতীত রাজা বা রাণীর কোন অস্তিত্ব নেই। যদিও বর্তমানে রাজা বা রাণীর ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে এবং রাজতন্ত্র নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রে পরিণত হয়েছে তথাপি রাজতন্ত্রের গৌরব, ঐতিহ্য বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ণ হয় নি, বরং যুগ যুগ ধরে টিকে থাকা রাজতন্ত্রের ভীত আরও সুদৃঢ় হয়েছে, তাছাড়া ব্রিটেনের রাজতন্ত্র ঐক্যের প্রতীক হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে। সুতরাং একথা বলা যুক্তিযুক্ত হবে যে, রাজা এবং রাজতন্ত্রের পার্থক্য থাকলেও রাজতন্ত্রের কোনরূপ ক্ষতি সাধিত হয় নি।