ব্রিটেনের রাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ আলোচনা কর।

রকেট সাজেশন
রকেট সাজেশন

অথবা, ব্রিটেনের রাজতন্ত্র টিকে থাকার সম্ভাবনা উল্লেখ কর।
অথবা, ব্রিটেনের রাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারণা দাও।

উত্তরঃ ভূমিকা: ব্রিটেনের রাজতন্ত্র ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার একটি প্রাচীনতম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থায় রাজতন্ত্রের ব্যাপক গুরুত্ব বা ভূমিকা বিদ্যমান। বলা হয় রাজশক্তি যাবতীয় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার উৎস। কিন্তু ব্রিটেনের সংসদীয় গণতন্ত্রে রাজা বা রাণীর প্রয়োগযোগ্য ক্ষমতা নেই বললেই চলে। রাজতন্ত্রের ভূমিকা তত্ত্বসর্বস্ব মাত্র এবং রাজা বা রাণী নিয়মতান্ত্রিক প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছে, ভবিষ্যতে রাজতন্ত্র টিকে থাকবে কি না। অবশ্য ব্রিটেনের রাজতন্ত্র যেভাবে তার ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের সাথে।

সুসম্পর্ক ধরে রেখেছে: তাতে বলা যায়, যতদিন ব্রিটেনে সংসদীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান থাকবে, ততদিন রাজতন্ত্রও বিদ্যমান থাকবে।

ব্রিটেনে রাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ: The king is dead, long live the king and the king never, এ প্রবচনগুলো আপাতদৃষ্টিতে বিভ্রান্তির মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তাৎপর্যপূর্ণ ও গ্রহণীয়। কেননা ব্যক্তি রাজা বা রাণী যে কোন
মানুষের মতোই মরণশীল, কিন্তু ব্যক্তি রাজা বা রাণীর মৃত্যু বাজতন্ত্রের ধারাবাহিকতাকে ক্ষুন্ন করে না। রাজপদে অধিষ্ঠিত কোন ব্যক্তির মৃত্যু হলে, সাথে সাথে তার উত্তরাধিকারী এ পদে অধিষ্ঠিত হন।

১. ইংরেজ আতির রক্ষণশীল চরিত্র: ইংরেজ জাতি প্রকৃতিগতভাবে রক্ষণশীল মনোবৃত্তিসম্পন্ন হওয়ার জন্য সুদীর্ঘকালের ঐতিহ্য সমন্বিত এ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে তারা সহজেই বিনষ্ট করতে চায় না। এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে অধ্যাপক বার্কার বলেছেন, “রাজতন্ত্রের গতি আমাদের ঐতিহ্যপূর্ণ জাতীয় জীবনের নিরবচ্ছিন্নতা মনে করিয়ে দেয়। তাই ১৯৫৭ সালে লর্ড আলট্রিনচান রাজতন্ত্রের বিলোপসাধনের প্রস্তাব করলে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় উঠে।”

২. রাজনীতি নিরপেক্ষ : রাজশক্তি যদি রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে জড়িয়ে পড়ত, তাহলে অনেক আগেই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী পার্লামেন্ট আইন প্রণয়নের মাধ্যমে তার বিলোপসাধন করত। কিন্তু রাজা বা রাণী সবসময় রাজনৈতিক দলাদলির ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন বলে তারা সব রাজনৈতিক দল কিংবা সর্বশ্রেণীর, মানুষের কাছে আজও অতি আপনজন বলে বিবেচিত হন।

৩. ব্যয়বহুল নয়: অনেকের মতে, ব্রিটেনের রাজপদ বংশানুক্রমিক বলে অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের নির্বাচনে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়িত হয়, এখানে তা হয় না। রাজতন্ত্রের পিছনে ব্যয় মোট রাজস্বের শতকরা একভাগ মাত্র। দেশের শাসনব্যবস্থায় রাজপদের উপযোগিতার তুলনায় এ ব্যয় ইংরেজদের কাছে যৎসামান্য।

৪. দেশপ্রেম জাগরিত করে: আপামর জনসাধারণ রাজা বা রাণীকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে এবং তাঁর প্রতি অখণ্ড
আনুগত্য প্রদর্শন করে। এ আনুগত্য প্রদর্শন দেশপ্রেমেরই বহিঃপ্রকাশ। এজন্য অধ্যাপক Jennings রাজতন্ত্রকে দেশপ্রেমের মূর্ত প্রতীক বলে বর্ণনা করেছেন।

৫. জীবনে বৈচিত্র্য আনে রাজশক্তি ব্রিটেনবাসীর একঘেয়ে জীবনে বৈচিত্র্যের সন্ধান দেয়। রাজা বা রাণীর মহাসমারোহে সিংহাসনে আরোহণ, রাজ পরিবারের জাঁকজমকপূর্ণ বিবাহ ইত্যাদি বাহ্যাড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানাদি জনসাধারণের বৈচিত্র্যহীন জীবনে নতুনত্বের স্বাদ এনে দেয়। C. Moodie উল্লেখ করেছেন, “The most obvious function of the monarchy is to provide colour and pageantry in a society where in neither otherwise predominates.”

৬. রাজা বা রাণীর ব্যক্তিগত ভূমিকা: কোন কোন রাজা বা রাণীর ব্যক্তিগত চরিত্রের মাধুর্য, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও
সীমাহীন দূরদর্শিতা যুক্তরাজ্যের জনগণের কাছে রাজশক্তিকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। উদাহরণ হিসেবে, হ্যানোভার বংশের রাণী ভিক্টোরিয়া (১৮৩৭-১৯০১) কিংবা উইল্ডজোর বংশের রাজা পঞ্চম জর্জের (১৯১০-১৯৩৬) কথা উল্লেখ করা যায়।

৭. জাতীয় ঐক্যের প্রতীক: জনসাধারণের কাছে রাজপদ হল ঐক্যের প্রতীক, ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক, সর্বজনীন প্রতিনিধি এবং ভবিষ্যৎ আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রস্থল। রাজা কোন বিশেষ দল বা শ্রেণীর প্রতিনিধি নন, তিনি জাতির প্রধান। সর্বসাধারণের রাজা বা রাণী এ অনুভূতি ইংরেজদের মধ্যে দেশপ্রেমের সৃষ্টি করে।

৮. গণতন্ত্রের বিকাশের পথে প্রতিবন্ধক নয়: ব্রিটেনের রাজতন্ত্র গণতন্ত্র বিকাশের পথে প্রতিবন্ধক নয়। এ প্রসঙ্গে। Ogg and Zink বলেছেন, “ব্রিটিশ রাজশক্তি ব্রিটেনের সরকারি ব্যবস্থায় প্রগতিশীল বিকাশের পথে কখনও বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি।” তাই এরূপ প্রতিষ্ঠানের বিলোপসাধনে কেউ কোন দিন আন্তরিকভাবে চেষ্টা করে নি।

৯. মনস্তাত্বিক কারণ: ব্রিটেনের রাজা বা রাণীকে ব্রিটিশরা পিতামাতার মত অভিভাবক কিংবা ঈশ্বরের ন্যায় শ্রদ্ধা করে। সেখানে প্রচলিত একটি প্রবাদ বাক্য থেকে এ উক্তির সত্যতা প্রমাণিত হয়। প্রবাদটি হল, “With the King of Queen in the Buckingham Palace people sleep quitely in their beds.”

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বিভিন্ন কারণে ব্রিটেনের রাজতন্ত্র আজও টিকে আছে এবং যতদিন সেখানে সংসদীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান থাকবে, ততদিন রাজতন্ত্রও বিদ্যমান থাকবে। তাছাড়া যেহেতু ইংরেজরা অতিমাত্রায় রক্ষণশীল, সেহেতু তারা তাদের পুরাতন ঐতিহ্য বজায় রাখার জন্য রাজতন্ত্রকেও ভবিষ্যতে টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করবে। তাছাড়া পৃথিবীর অন্য কোথাও ব্রিটেনের রাজতন্ত্রের ন্যায় নিরাপদ ও শ্রদ্ধাভাজন রাজতন্ত্রের অস্তিত্ব নেই।সুতরাং বলা যায় যে, ব্রিটেনের রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হওয়ার নয় তবে এর জৌলুস ভবিষ্যতে কিছুটা হ্রাস পেতে পারে।