ব্রিটিশ সংবিধান অলিখিত হওয়ার কারণসমূহ আলোচনা কর।

রকেট সাজেশন
রকেট সাজেশন

অথবা, ব্রিটিশ সংবিধান কেন অলিখিত, তা ব্যাখ্যা কর।
অথবা, ব্রিটিশ সংবিধান অলিখিত, ব্যাখ্যা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: বর্তমান বিশ্বের সংবিধানসমূহের মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী সংবিধান হচ্ছে গ্রেট
ব্রিটেনের। এ সংবিধান সম্পর্কে Munro মন্তব্য করেন, “The British Constitution is the mother of all constitution.” তাই এ সংবিধানের বৈশিষ্ট্য অন্যান্য সংবিধান থেকে কিছুটা ভিন্ন প্রকৃতির। ব্রিটিশ সংবিধানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল, এ সংবিধান অলিখিত। এ কারণে অনেক সংবিধান বিশ্লেষকগণ ব্রিটেনের সংবিধানের অস্তিত্বকে স্বীকার করেন নি। তথাপি যুগ যুগ ধরে ব্রিটেনের সংবিধান টিকে থাকে এবং অন্যান্য দেশের সংবিধানের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করছে।

ব্রিটিশ সংবিধান অলিখিত হওয়ার কারণসমূহ: অলিখিত সংবিধান হিসেবেই ব্রিটিশ সংবিধান সর্বাধিক পরিচিত। আর অলিখিত হওয়ার পিছনে যে কোন কারণই নেই, তা ঠিক নয়, বরং বিভিন্ন কারণেই ব্রিটিশ সংবিধান লিখিত আকারে প্রকাশিত হয় নি। তাই ব্রিটিশ সংবিধান কেন অলিখিত তা জানা জরুরি। নিম্নে ব্রিটিশ সংবিধান। অলিখিত হওয়ার কারণসমূহ আলোচনা করা হল।

১. ঐতিহাসিক কারণ: ব্রিটিশ সংবিধান একদিনে তৈরি হয় নি বরং বিভিন্ন সময়ের ঐতিহাসিক ক্রমবিবর্তনের ধারায় এটি বিকাশ লাভ করেছে। আর বিকাশের শুরু থেকে এ সংবিধান অলিখিতই রয়ে গেছে। সুতরাং ব্রিটিশ সংবিধান অলিখিত হওয়ার পশ্চাতে ঐতিহাসিক কারণ বিদ্যমান রয়েছে। ঐতিহাসিক পটভূমি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে. সংবিধান রচনার জন্য যে পরিবেশ পরিস্থিতি প্রয়োজন তা ব্রিটিশ ইতিহাসে ছিল অনুপস্থিত। কেননা ব্রিটেন কখনও কোন দেশের উপনিবেশ বা পরাধীন ছিল না। ফলে কারও অধীনতা হতে মুক্ত হয়ে নিজস্ব সংবিধান তৈরির প্রয়োজন ব্রিটেনের হয় নি। তাই তারা প্রচলিত রীতিনীতিকেই তাদের শাসনব্যবস্থা পরিচালনার উপাদান হিসেবে গ্রহণ করেছে।

২. জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অনুপস্থিতি: সংবিধান লিখিত হওয়ার একটি অন্যতম কারণ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। পৃথিবীর যেসব দেশে লিখিত সংবিধান রয়েছে, সেসব দেশের অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তারা কোন না কোন দেশের অধীনে ছিল এবং দীর্ঘদিন স্বাধীনতা অর্জনের আন্দোলন করে মুক্ত হয়ে সংবিধান রচনা করেছে। কিন্তু ব্রিটেনের ইতিহাসে তা নেই। অর্থাৎ তাদেরকে স্বাধীনতা লাভের জন্য কোন সময় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন
করতে হয় নি। ফলে সংবিধান রচনার কোন প্রয়োজন হয় নি।

৩. বিপ্লব বিদ্রোহ অনুপস্থিত: রাজনৈতিক আদর্শ পরিবর্তনের ফলে সংবিধান লিখিত আকারে প্রকাশিত হতে পারে। যেমন-চীনে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে সফল আন্দোলনের ফলে তারা নতুন সমাজতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করে। কিন্তু ব্রিটেনে এমন কোন বিপ্লব বিদ্রোহের সৃষ্টি হয় নি। ফলে সংবিধান লেখার পরিবেশ সৃষ্টি হয় নি।

৪. অভিজ্ঞতার প্রাধান্য: ব্রিটেনের জনগণ দেশের শাসনতন্ত্রের ব্যাপারে অভিজ্ঞতাকেই অধিক প্রাধান্য দিয়ে থাকে। বর্তমানে প্রশাসনের প্রয়োজন পূরণই তাদের লক্ষ্য এবং এজন্য শাসনব্যবস্থা পরিচালনাকারীগণ শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণেই বেশি উৎসাহী। তাই সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ বিধিবিধানগুলো বিধিবদ্ধ করার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ কম।

৫. রাজনৈতিক কারণ: নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থার মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দল ব্রিটেনের শাসনক্ষমতা গ্রহণ করে এবং নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত দেশ পরিচালনা করে থাকে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল দেশের ক্ষমতা গ্রহণ বা দেশ
পরিচালনার এ নীতি কোথাও লিপিবদ্ধ নয়, বরং প্রচলিত রীতি অনুযায়ীই এ নিয়ম যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। আর এ নিয়ম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কখনও কোনরূপ সমস্যা সৃষ্টি হয় নি বা রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় নি। শুধুমাত্র নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণের প্রক্রিয়াই নয় দেশের আইন ব্যবস্থা, শাসনব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা দিনের পর দিন এরূপ অলিখিত দলিলের উপরই টিকে আছে এবং সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হচ্ছে। সুতরাং বলা যায় যে, রাজনৈতিক কারণেও ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত।

৬. সামাজিক কারণ: দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত প্রথা বা সাংবিধানিক রীতিনীতির সমন্বয়ে ব্রিটেনে যে সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে এবং বর্তমান সময় পর্যন্ত টিকে রয়েছে তার স্থায়িত্বের জন্য লিখিত দলিলের প্রয়োজন হয়। তাই অনেকে মনে। করেন, সাংবিধানিক রীতিনীতির উপস্থিতির কারণেই ব্রিটেনের সংবিধানকে অলিখিত বলা হয়। মূলত ব্রিটিশ সংবিধানের কাঠামো, এ সাংবিধানিক রীতিনীতির উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। এর দ্বারাই নির্ধারিত হয় রাজশক্তির সাথে পার্লামেন্ট ও ক্যাবিনেটের সম্পর্ক এবং পার্লামেন্টের কক্ষের মধ্যকার সম্পর্ক কিরূপ হবে।

৭. মনস্তাত্বিক কারণ: ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত হওয়ার পিছনে মনস্তাত্ত্বিক কারণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ব্রিটেনের জনগণ মানসিকভাবেই গ্রহণ করে নিয়েছে যে, তাদের দেশের সংবিধান অলিখিত। এক্ষেত্রে অবশ্য কোন কোন ইংরেজ গর্ববোধ করে যে, তাদের দেশের সংবিধান অলিখিত কিন্তু এ সংবিধান পৃথিবীর অধিকাংশ সংবিধানের উপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে, বরং বর্তমানে যদি কেউ ব্রিটেনের সংবিধান লিখিত আকারে প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করে তবে দেখা যাবে যে, সমগ্র ব্রিটেনের জনগণ এর তীব্র বিরোধিতা শুরু করেছে এবং দেশে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি হবে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকেই এটি এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত যে তা পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।

৮. উৎসগত কারণ: ব্রিটেনের সংবিধান কোন নির্দিষ্ট সূত্র বা উৎস হতে উদ্ভব হয় নি, বরং সাংবিধানিক রীতিনীতি ও ঐতিহ্যই এ সংবিধানের ব্যাপক অংশ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। যার কারণে ব্রিটেনের সংবিধানকে বলা হয় গতিশীল সংবিধান। আর উৎসগত ভিন্নতার কারণেই ব্রিটেনের সংবিধানকে লিখিত রূপ দেয়া সম্ভব হয় নি।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত হওয়ার পিছনে এক নয় বহু কারণ বিদ্যমান। লিখিত আকারে বিধিবদ্ধ না হলেও এ সংবিধান যুগের পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং বিশ্বের বিভিন্ন সংবিধানের উপর এর প্রভাব সুস্পষ্ট। মূলত অলিখিত হওয়ার কারণেই ব্রিটেনের সংবিধান অন্যান্য দেশের সংবিধানের তুলনায় বিশেষ বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এবং বিশ্বের অন্যতম সংবিধান হিসেবে পরিচিত। পরিশেষে ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত হওয়ার কারণ সম্পর্কে অধ্যাপক মুনরোর সাথে একমত হয়ে বলা যায় যে, “The British Constitution is not drived from one source but from several.”