অথবা, নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র কী! অথবা, নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র বলতে কী বুঝ।
অথবা, নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র সম্পর্কে কী জান? লিখ।
উত্তর: ভূমিকা: বর্তমান বিশ্বের একটি বহুল আলোচিত শব্দ হচ্ছে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র। রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, প্রাচীন কালের গ্রিক নগররাষ্ট্রের কাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের ধারা অব্যাহত গতিতে প্রবাহমান হচ্ছে। পৃথিবীর অনেক দেশেই নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রচলিত রয়েছে এবং অনেক দেশ এ ব্যবস্থা চালুর জন্য চেষ্টা করছে। এ শাসনব্যবস্থায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং নিয়মতান্ত্রিক বা সাংবিধানিক রাজার সকল ক্ষমতার উৎস হয় জনগণ।
নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র: সাধারণ অর্থে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র বা সাংবিধানিক রাজতন্ত্র বলতে সংবিধানের প্রতি অনুগত বা সংবিধান অনুযায়ী পরিচালিত সরকারকেই বুঝায়। কিন্তু কোন দেশে সংবিধান থাকলেই বা রাজা সংবিধানের প্রতি অনুগত থাকলেই তাকে পুরোপুরি নিয়মতান্ত্রিক বা সাংবিধানিক সরকার বলা যায়। না। কেননা রাষ্ট্রের সংবিধান যদি রাজার শাসন ক্ষমতা প্রয়োগের উপর যথার্থ বিধিনিষেধ আরোপ না করে তাহলে সেই রাষ্ট্রের রাজতন্ত্রকে পুরোপুরি নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র বলা যাবে না। কোন রাষ্ট্রে যথার্থ নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে হলে রাজাকে সংবিধান অনুযায়ী অনেক ক্ষমতাই দেয়া হবে কিন্তু সেগুলোর উপর যথেষ্ট বিধিনিষেধও থাকতে হবে এবং এর পিছনে জনগণের সমর্থন থাকতে হবে। সুতরাং সামগ্রিকভাবে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র বলতে এমন এক শাসনব্যবস্থাকে বুঝায় যেখানে জনগণের সমর্থনপুষ্ট সংবিধান অনুযায়ী রাজার শাসন ক্ষমতার উপর কার্যকর বাধানিষেধ আরোপ করা যায়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা: নিয়মতান্ত্রিক বা সাংবিধানিক রাজতন্ত্র সম্পর্কে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্ন অভিমত ব্যক্ত করেছেন।সেগুলো নিমরূপ:
প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন (Woodrow Wilson) এর মতে, “যে রাজতন্ত্র জনস্বার্থ ও ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার্থে নিয়োজিত থাকে তাকে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র বলে।”
অধ্যাপক কে. সি. হুইয়ার (K. C. Wheare) এর মতে, “সাংবিধানিক রাজতন্ত্র কেবল সংবিধানের বিধান অনুযায়ী রাজতন্ত্র নয়, এ রাজতন্ত্র আইন ও সংবিধানের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কার্যকরী করে।”
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী উইলোবি (Willoughby) এর ভাষায়, “আইনের অনুগত ও আইনের দ্বারা সীমাবদ্ধ রাজতন্ত্রকে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র বলে।”
অধ্যাপক কার্ল জে ফ্রেডারিক (Carl J. Friedrich) বলেছেন, “ক্ষমতার বিভক্তিকরণ যে কোন সভ্য সমাজের ভিপ্তি। আর এটাই হচ্ছে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র বা সংবিধানবাদের প্রকৃত অর্থ।”
The Dictionary of Sociology’ তে বলা হয়েছে, “নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র বলতে বুঝায় কোন রাজনৈতিক সমাজের কর্তৃত্বশালী শাসকগণের উপর কার্যকর এবং নিয়ম প্রণালিবদ্ধ বাধানিষেধ আরোপণ ব্যবস্থা।” সুতরাং উপর্যুক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায় যে, নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র হচ্ছে সংবিধানসম্মত রাজতন্ত্র যা রাষ্ট্রীয় আইন ও সংবিধানের মাধ্যমে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত। তাই এ ধরনের রাজতন্ত্রকে সীমাবদ্ধ রাজতন্ত্র বলেও অবিহিত করা হয়।
উপসংহার: উপর্যুক্ত সামগ্রিক আলোচনা হতে বলা যায় যে, জনগণের অধিকার রক্ষাই হচ্ছে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের অপরিহার্য শর্ত। এ রাজতন্ত্র গণতান্ত্রিকভাবে জনগণের অধিকার রক্ষা করে। ব্রিটেন, স্পেন, কানাডা থেকে শুরু করে বিশ্বের প্রায় প্রত্যেকটি উন্নত দেশে সাংবিধানিক বা নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই বলা যায়, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও উন্নত করার জন্য নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের গুরুত্ব অপরিসীম।