অথবা, আইনের অনুশাসন বলতে কী বুঝ?
অথবা, আইনের অনুশাসন কী? অথবা, আইনের অনুশাসন দ্বারা কী বুঝায়?
অথবা, আইনের অনুশাসনের সংজ্ঞা দাও।
উত্তরঃ ভূমিকা: উদারনৈতিক গণতন্ত্রের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত ব্রিটেনের সংবিধানের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল আইনের অনুশাসন (The Rule of Law)। আইনের অনুশাসন যদিও একটি প্রাচীন নীতি, তথাপি ব্রিটিশ সংবিধানেই সর্বপ্রথম আইনের অনুশাসন সাংবিধানিক মর্যাদা লাভ করে। ব্রিটিশ নাগরিকদের অধিকার ও স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হল আইনের অনুশাসন। আইনের অনুশাসন বলতে আইনের সুপ্রতিষ্ঠিত প্রাধান্যকে বুঝায়।
তাত্ত্বিক মহল বলেছেন, “In the eyes of the law, all persons whether big or small the highest capitalist or poor man are equal violating of law.” ব্রিটেনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আইনের অনুশাসন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়।
আইনের অনুশাসন: আইনের অনুশাসন অর্থ আইনে সুপ্রতিষ্ঠিত প্রাধান্য। আইনের অনুশাসন বলতে বুঝায় শাসক (প্রধানমন্ত্রী) এবং শাসিত (সাধারণ নাগরিক) একই আইনের অধীনে। উভয়ে একই আইনের দ্বারা আবন্ধ ও পরিচালিত। কারও জন্য কোন Separate Law or Court থাকবে না।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা: আইনের অনুশাসনকে বিভিন্ন চিন্তাবিদ বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। নিম্নে তাঁদের কয়েকটি সংজ্ঞা উপস্থাপন করা হল।
Prof. Jennings বলেছেন, “প্রকৃত অর্থে আইনের শাসন বলতে একটি গণতান্ত্রিক বা সাংবিধানিক সরকার ব্যবস্থাকে বুঝায়, যেখানে সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা শুধু অনুমোদিত নয়, বরং একটি উত্তম গুণ এবং রাজনীতি শুধু গ্রহণযোগ্য নয়, বরং উৎসাহিত করা হয়। যেখানে এ বৈশিষ্ট্যগুলো থাকে, সেখানে আইনের শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো আপনা- আপনি নির্গত হয়।”
লর্ড হিউয়ার্ট এর মতে, “আইনের অনুশাসন বলতে ব্যক্তিস্বাধীনতা নির্ধারণ বা সংরক্ষণের জন্য সাধারণ আইনের সার্বভৌমত্ব বা প্রাধান্যকে বুঝায়।”
রোমান দার্শনিক আইনবিদ সিসেরোর মতে, “আইনের অনুশাসন হচ্ছে সভ্যতার ভিত্তিস্বরূপ।”
১৮৮৫ সালে A. V. Dicey সর্বপ্রথম তাঁর ‘Law of the Constitution’ নামক সুবিখ্যাত গ্রন্থে আইনের অনুশাসনের নিয়মতান্ত্রিক ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। আইনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “আইনের অনুশাসন হচ্ছে ব্রিটেনের সব রাজনৈতিক কার্যকলাপের মূলসুর। এটি ব্রিটেনের ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রধান রক্ষাকবচ এবং ব্রিটিশ জাতির গৌরবময় ঐতিহ্যের মুখ্য প্রতীক হিসেবে পরিচিত।” তিনি আইনের অনুশাসনের তিনটি ব্যাখ্যা প্রদান করেন। যথা:
১. স্বৈরী ক্ষমতার অনুপস্থিতি: সরকারের শ্বৈরী ক্ষমতার পরিবর্তে আইন হবে চূড়ান্তভাবে সার্বভৌম। সরকারের এমন কোন বিশেষ স্বৈরাচারী বা স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা নেই, যার বলে সে ব্যক্তির স্বাধীনতা খর্ব করে। সুস্পষ্টভাবে আইন ভঙ্গের প্রমাণ না পাওয়া গেলে আদালত কর্তৃক শাস্তি প্রদান করা যাবে না। অথবা তাকে জীবন ও সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।
২. আইনের চোখে সমতা: কোন ব্যক্তিই আইনের উর্ধ্বে নয়। আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান। ক্ষমতা, পদমর্যাদা ও অবস্থাবিশেষে প্রত্যেক ব্যক্তি দেশের সাধারণ আইনের অধীন এবং সাধারণ আদালতের নিকট সকলেই দায়িত্বশীল থাকবে। আইনের চোখে সাধারণ নাগরিক ও সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে কান পার্থক্য নেই।
৩. নাগরিক অধিকার: অন্যান্য দেশে যেমন সংবিধান দ্বারা নাগরিক অধিকারসমূহ স্বীকৃত, তেমনি ইংল্যান্ডের জনগণের অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং সাধারণ আইন দ্বারাই সেগুলো সংরক্ষিত হয়। সুতরাং সংবিধান হচ্ছে দেশের সাধারণ আইনের ফলশ্রুতি। অর্থাৎ Dicey অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদানকারী হিসেবে আদালতের ভূমিকার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। এছাড়াও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণার মাধ্যমে আইনের অনুশাসনের পরিধি ব্যাপকতা লাভ করেছে। এখন আইনের অনুশাসন বলতে মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিতকরণ ও জনগণের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধানকে বুঝায়।
উপসংহার: আইনের অনুশাসন স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে জনগণের অধিকার আদায়ে এক বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে থাকে। এ নীতি জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষায় ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করেছে। তাই নাগরিক অধিকারের সাথে আইনের শাসন ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত।