অথবা, কী উপায়ে সঠিক জনমত গঠন করা যায়?
অথবা, সঠিক জনমত গঠনের পূর্বশর্তসমূহ আলোচনা কর।
উত্তর: ভূমিকা : জনমত সম্পর্কিত ধারণার উৎপত্তির ইতিহাস অস্পষ্ট। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় জনমত কথাটি নতুন নয়। তবে জনমত সংক্রান্ত ধারণা মোটামুটি প্রাচীন গ্রিক এবং রোমান আইনে জনমত সম্পর্কিত ধারণার সন্ধান পাওয়া যায়। মধ্যযুগেও এ ধারণা প্রচলিত ছিল। তবে এ সময়কার চিন্তাবিদদের লেখায় এ বিষয়ে সুস্পষ্ট এবং বিজ্ঞানসম্মত আলোচনার অভাব ছিল। সর্বপ্রথম ফরাসি দার্শনিক রুশো-এর রচনায় ‘জনমত’-এর রাজনৈতিক পরিচয় পাওয়া যায়।
সুষ্ঠু জনমত গঠনের শর্তাবলি (Means to organize public opinion) : জনমতকে সুস্থ, সজ্ঞান ও সচেতন করতে হলে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা উচিত। নিম্নে এগুলো যথাপরিসরে আলোচনা করা হলো :
১. সুষ্ঠু মাধ্যম : জনমত গঠনের মাধ্যমগুলো সুষ্ঠু ও সঠিক পথে পরিচালিত হতে হবে যেন তা কোন স্বার্থার্থে মহলের আয়ত্তে না আসে এবং জনস্বার্থে উদ্বুদ্ধ হয় ও সঠিকভাবে জনকল্যাণার্থে জনমত কাজে লাগে।
২.ব্যাপক শিক্ষাবিস্তার : ব্যাপক শিক্ষাবিস্তারের মাধ্যমে জনগণ যেন সচেতন হয়ে উঠতে পারে এবং কুচক্রীদের দ্বারা বিভ্রান্ত হয় না।
৩. নিরপেক্ষ সংবাদ মাধ্যম: সংবাদপত্রগুলো যেন নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জনমত গঠনে সাহায্য করতে পারে সেদিক থেকে সচেষ্ট হতে হবে।
৪. জনগণের রাজনৈতিক চেতনার উন্নত স্তর : জনমত সুষ্ঠুভাবে সংগঠিত হতে হলে জনগণকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন হতে হবে এবং জাতীয় সমস্যা অনুধাবনে সক্ষম হতে হবে।
৫. সহনশীলতা ও শ্রদ্ধাবোধ : পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং সহনশীলতা সুষ্ঠু জনমত গঠনের আরেকটি শর্ত। কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা, ব্যক্তিগত স্বার্থ এবং সকীর্ণতার মধ্যে সুষ্ঠু জনমত গঠিত হয় না।
৬. সংবাদ মাধ্যমগুলোর বস্তুনিষ্ঠতা : বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা, বিশেষ করে বিশেষ শ্রেণি বা বিশেষ অঞ্চলের প্রভাবমুক্ত হয়ে নিরপেক্ষভাবে সংবাদ পরিবেশন সম্ভব না হলে সুষ্ঠু জনমত গড়ে উঠে না।
৭. জনগণের রাজনৈতিক শিক্ষা ও প্রচার: জনগণের মধ্যে ব্যাপক রাজনৈতিক প্রচার ও যথাযথ রাজনৈতিক শিক্ষা সুষ্ঠু জনমত গঠনের একটি উল্লেখযোগ্য পূর্বশর্ত। রাজনৈতিক বিষয়াদির ব্যাপক প্রচার ও জনগণকে রাজনৈতিক বিষয়ে সচেতন করে তুলে জনমত সুনিশ্চিত করা যায়।
৮. প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি : একথা সর্বজনস্বীকৃত যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভাবী নাগরিক গড়ে তোলার এক আদর্শ স্থান। বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীগণ যে শিক্ষা লাভ করে এবং যে ধ্যানধারণা ও আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় তাই তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের পাথেয় হয়ে থাকে। পরবর্তী জীবনে তা তাদের চিন্তাভাবনা ও কর্মকাণ্ডকে বহুলাংশে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করে। তারা দেশপ্রেমের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বিষয়াদি ও সমস্যাদির ব্যাপারে স্বাধীন ও অবাধ মতামত অর্থাৎ সুষ্ঠু জনমত গঠন করতে পারে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ফলেই। যে কোন দেশে শিক্ষাব্যবস্থার উপর অতিরিক্ত সরকারি হস্তক্ষেপ বাঞ্ছনীয় নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যাতে কোন বিশেষ রাজনৈতিক মতবাদের প্রচারণা স্থলে পরিণত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা একান্ত আবশ্যক। আর তা করতে হবে সুষ্ঠু জনমত গঠনের স্বার্থেই।
৯. নিরপেক্ষ, সত্য ও নির্ভুল সংবাদ পরিবেশন: জনগণের উপর সংবাদপত্রের প্রভাব যথেষ্ট হওয়ায় সুষ্ঠু জনমত গঠনের শর্ত হিসেবে সাংবাদিকদের উচিত স্বাধীন, নিতীক ও নিরপেক্ষভাবে সত্য ও নির্ভুল সংবাদ পরিবেশন করা। বর্তমানে সংবাদপত্র প্রকাশনা এক বড় ব্যবসায় পরিণত হয়েছে এবং অধিকাংশ সংবাদপত্রই বড় বড় পুঁজিপতিদের মালিকানাধীন এবং তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এর ফলে সঠিক ও সুষ্ঠু জনমত প্রকাশের ক্ষেত্রে এক বিরাট বাধার সৃষ্টি হচ্ছে।তাই সাংবাদিকদের উচিত জনস্বার্থে ও সুষ্ঠু বানমঞ্চের স্বার্থে সৎ, সাহসী ও নির্ভীকভাবে সংবাদ পরিবেশন করা।
১০. চলচ্চিত্র, বেতার ও টেলিভিশন চলচ্চিত্র, বেতার ও টেলিভিশন: জনমত গঠনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। তাই সুষ্ঠু জনমত গঠনের স্বার্থে এগুলোর যথাযথ নিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বর্তমানে প্রায় সবদেশেই এ মাধ্যমগুলো সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়ে থাকে। এমতাবস্থায় তারা সুষ্ঠু জনমত গঠনের উপযুক্ত মাধ্যম হিসেবে পরিণত হতে পারে না। ফলে গণতান্ত্রিক সকল ব্যবস্থা পদদলিত হয় এবং রাষ্ট্রীয় কল্যাণ ব্যাহত হয়। তাই এগুলোর সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ ও যথাযথ স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করা উচিত।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, জনমত সজ্ঞান ও সুষ্ঠু হলে এবং শাসনব্যবস্থায় কার্যকরী জনপ্রভাব বিস্তার করলে গণতন্ত্রের সুদিন ফিরবে। আর তাই একটি গণতান্ত্রিক দেশে সুষ্ঠু গণতন্ত্র চর্চার স্বার্থে এবং জনমতকে সুষ্ঠুভাবে গড়ে তোলার স্বার্থে উপর্যুক্ত শর্তগুলোকে বাস্তবায়ন করা হয়। তাহলেই জনমত সুষ্ঠু, সুশীল ও কার্যকরীভাবে গঠন করা সম্ভব হবে।