“প্রেস যেভাবে চায় জনমত সেভাবে গড়ে উঠে।” জনমত গঠনের ক্ষেত্রে প্রেসের গুরুত্ব বিশ্লেষণ করে উক্তিটির যথার্থতা নির্ণয় কর।

রকেট সাজেশন
রকেট সাজেশন

অথবা, “প্রেস যেভাবে চায় জনমত সেভাবে গড়ে উঠে।” জনমত গঠনের ক্ষেত্রে প্রেসের তাৎপর্য তুলে ধরে উক্তিটির যথার্থতা বিচার কর।

উত্তরঃ ভূমিকা : জনমত সম্পর্কিত ধারণার উৎপত্তির ইতিহাস অস্পষ্ট। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় জনমত কথাটি নতুন নয়। তবে জনমত সংক্রান্ত ধারণা মোটামুটি প্রাচীন। গ্রিক এবং রোমান আইনে জনমত সম্পর্কিত ধারণার সন্ধান পাওয়া যায়। মধ্যযুগেও এ ধারণা প্রচলিত ছিল। তবে এ সময়কার চিন্তাবিদদের লেখায় এ বিষয়ে সুস্পষ্ট এবং বিজ্ঞানসম্মত আলোচনার অভাব ছিল। সর্বপ্রথম ফরাসি দার্শনিক রুশো-এর রচনায় ‘জনমত’-এর রাজনৈতিক পরিচয় পাওয়া যায়।

জনমত গঠনের বাহন হিসেবে প্রেসেরে গুরুত্ব : আধুনিক রাষ্ট্রে জনমতের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। জনমতই এর ভিত্তিপ্রস্তর। বিশেষ করে গণতান্ত্রিক সরকারের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য সত্যিকার বিচারবুদ্ধিভিত্তিক সজাগ জনমত একান্ত আবশ্যক। সত্যিকার জনমত গঠন ও প্রচারের উপরই গণতান্ত্রিক সরকারের সফলতা বহুলাংশে নির্ভর করে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কিভাবে সত্যিকার জনমত গঠন করা যায়? প্রত্যেক রাষ্ট্রেই জনমত গঠনের কতকগুলো বাহন বা মাধ্যম দৃষ্ট হয়। এ বাহনগুলো এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, তারাই জনমতের সঠিক অর্থ নির্ধারণ ও কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। এ দৃষ্টিকোণ থেকেই বলা হয় যে, “বাহন যা করে তাই জনমত।” (Public opinion is what its media made it to be). কিংবা, “প্রেস যেভাবে চায় জনমত সেভাবে গড়ে উঠে। সে যাই হোক, আমাদের আলোচনায় জনমত গঠনের ক্ষেত্রে প্রেসের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এবং উপর্যুক্ত বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করা হয়েছে। জনমত গঠনের জন্য প্রেস বলতে এখানে সংবাদপত্র, চলচ্চিত্র, বেতার, টেলিভিশন, সভাসমিতি, সাহিত্য পত্রিকা এবং অন্যান্য পুস্তক-পুস্তিকা ইত্যাদিকে বুঝানো হয়েছে। নিম্নে এগুলোর গুরুত্ব আলোচনা করা হলো :

১. সংবাদপত্র : জনমত গঠনের একটি উল্লেখযোগ্য বাহন হচ্ছে সংবাদপত্র। বর্তমান যুগে জনমত গঠনের ক্ষেত্রে সংবাদপত্রের ভূমিকা অত্যন্ত ব্যাপক। বস্তুত জনমত গঠনে এটা এক অনস্বীকার্য ভূমিকা পালন করে থাকে। জনমত গঠনের জন্য যেসব রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক তথ্যাদির উপর নির্ভর করতে হয় সেগুলোর জন্য সংবাদপত্রের প্রয়োজন অত্যধিক। গণশিক্ষা প্রসারের সাথে সাথে জনমত গঠনে সংবাদপত্রের প্রভাব ও ক্ষমতা অকল্পনীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। Prof. Herman Finer লিখেছেন, “আধুনিক কালে সংবাদপত্র শিক্ষার এমন এক মাধ্যমে পরিণত হয়েছে যা সর্বাপেক্ষা ব্যাপকভাবে প্রচারিত।” (The press is the most widely disseminated single agent of instruction in the modern world). সংবাদপত্র কেবল সংবাদই পরিবেশন করে না, এটা জাতীয় সমস্যাদির উপর মতামত ব্যক্ত করে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সংবাদপত্র দেশের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে শিক্ষাবিদ এবং মনীবীদের প্রবন্ধ ও নিবন্ধ প্রকাশ করে জনমত গঠনে সাহায্য করে থাকে। সেজন্য সংবাদপত্রকে সরকারের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ হতে মুক্ত রাখতে হবে। জাতীয় নির্বাচন ও বিভিন্ন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সংবাদপত্র সংবাদ পরিবেশন, বিশেষজ্ঞদের কলাম ও মতামত এবং বিশেষ ফিচার প্রকাশের মাধ্যমে জনমত গঠন করে থাকে। সংবাদপত্রের এ ধরনের জনমত গঠন প্রচেষ্টা সরকারের পক্ষেও যেতে পারে আবার বিপক্ষেও যেতে পারে।

২. চলচ্চিত্র : আধুনিক কালে জনমতকে প্রভাবিত করার অপর একটি শক্তিশালী মাধ্যম হলো চলচ্চিত্র। বর্তমানে চলচ্চিত্র অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এটা প্রধানত অবসর বিনোদন ও আনন্দ দানের মাধ্যম হলেও এটা সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের দুঃখ, বেদনা এবং আশা-আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিফলিত করে। সাম্প্রতিক ঘটনাবলির চিত্র ও বিভিন্ন ধরনের তথ্যচিত্র প্রদর্শন করে এটা জনগণের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে। এভাবে চলচ্চিত্র জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

৩. সাহিত্য, সাহিত্য পত্রিকা এবং অন্যান্য পুস্তক-পুস্তিকা: জনমত গঠন ও বিকাশের ক্ষেত্রে সাহিত্য পত্রিকা এবং বিভিন্ন পুস্তক-পুস্তিকার অবদানও কম নয়। এসব পুস্তক ও পত্রিকার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিভাবান লেখক ও ব্যক্তিবর্গ তাদের লেখনীর সাহায্যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সমস্যার প্রতি আলোকপাত করে জনগণকে সচেতন করে তোলেন। কাজেই জনমত সৃষ্টি ও গঠনের ক্ষেত্রে এদের প্রভাব সুদূরপ্রসারী।

৪. বেতার ও টেলিভিশন : জনমত গঠনে বেতার বা রেডিওর ভূমিকাও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বেতার অসংখ্য শিক্ষিত এবং নিরক্ষর মানুষের কাছে সংবাদ পরিবেশন করে। সুদূর পল্লিতে থেকেও বর্ণপরিচয়হীন মানুষ বেতারের মাধ্যমে দেশবিদেশের খবরাখবর পেয়ে থাকে এবং তাদের মতামত গঠনের ক্ষেত্র উর্বর হয়। আধুনিক কালে বেতার বা রেডিওর পাশাপাশি টেলিভিশনও জনমতের অপর একটি বাহন হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। বর্তমানে প্রায় সবদেশেই টেলিভিশন শুধু শহরাঞ্চলেই নয়, গ্রামাঞ্চলেও বিস্তৃতি লাভ করেছে। কাজেই জনমত গঠনের ক্ষেত্রে এ মাধ্যমটির গুরুত্ব রয়েছে যথেষ্ট পরিমাণে। বস্তুত এসব মাধমে যেভাবে জনমতকে প্রভাবিত করে এবং যেভাবে জনমত গঠন করতে চায়, জনমত মূলত সেভাবেই গড়ে উঠে

৫. সভাসমিতি এবং প্রেস রিলিজ : জনমত গঠনে বিভিন্ন সভাসমিতি ও প্রেস রিলিজের অবদানকেও অস্বীকার করা যায় না। জনগণকে দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাদি সম্পর্কে অবহিত এবং তাদের মতামতকে প্রভাবিত করার উপায় হিসেবে সভাসমিতি ও প্রেস রিলিজের গুরুত্ব অত্যধিক। সভাসমিতিতে বক্তাগণ অপর দলের মতামতের সমালোচনা ও রাষ্ট্রীয় সমস্যাবলি জনসমক্ষে তুলে ধরেন। ফলে শুধু জনমত গঠিত হয় না বরং প্রচারিত ও প্রভাবিতও হয়। এছাড়া বিভিন্ন কর্তা ব্যক্তি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের কিংবা সংগঠনের প্রেস রিলিজের মাধ্যমেও জনমত প্রভাবিত হয়।

পর্যালোচনা ও মন্তব্য: উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে একথা স্পষ্টত যে, জনমত সৃষ্টি ও গঠনের ক্ষেত্রে প্রেসের গুরুত্ব অপরিসীম। জনমত গঠনের জন্য মাধ্যম হিসেবে প্রেস হলো সর্বোৎকৃষ্ট এবং সরাসরি জনগণের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি বাহন। এজন্য প্রেসের মতামতের উপরই জনমতের আস্থা এবং বিশ্বাস প্রতিস্থাপিত হয়। আর এভাবে জনমত সৃষ্টি হ এবং প্রভাবিত হয়।

অতএব দেখা যায় যে, জনমত গঠনের ক্ষেত্রে প্রেসের ভূমিকা অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রেস জনমতের অনুঘটক হিসেবে কাজ করে বলে একথা যথার্থই বলা চলে যে, “প্রেস যেভাবে চায় জনমত সেভাবে গড়ে উঠে।” কিংবা, “বাহন যা করে তাই জনমত।”

উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, যেহেতু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠিত হয় জনমতের ভিত্তিতে এবং জনমত নির্ভর করে এর বাহনগুলোর উপর বিশেষত প্রেসের উপর, সেহেতু জনমত গঠন ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্থিতির জন্য প্রেসের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রেসই মূলত জনমতকে প্রভাবিত করে, সৃষ্টি করে এবং যে কোন জাতীয় নীতি ও সিদ্ধান্তের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে জনমত গঠনে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে। তাই একথা আজ পরিষ্কার যে, “প্রেস যেভাবে চায় জনমত সেভাবেই গড়ে উঠে। “