উত্তর: ভূমিকা : বর্তমান বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রেই রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। বর্তমানে নল ব্যবস্থা হলো গণতন্ত্রের প্রাণস্বরূপ। আধুনিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। গণতান্ত্রিক সরকারকে সফলকামী ও হিশীল করার জন্য এবং মানুষের কল্যাণসাধনের নিমিত্তে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহিষ্ণুতা, আলোচনা ও সমঝোতা একান্ত আবশ্যক Lord Bryee রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলেছেন, “রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তা অবশ্যদ্বাণী এবং কোন স্বাধীন বৃহৎ দেশ এটা বিবর্জিত নয়।” (Parties are invitable and no free. large country is without them.)
প্রসঙ্গ আলোচনা : রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে সহিষ্ণুতা, আলোচনা ও সমঝোতার অভাব উন্নয়নশীল দেশসমূহে
পাতান্ত্রিক সরকারের কার্যকারিতা বিনষ্ট করে। নিম্নোক্ত আলোচনার মাধ্যমে উক্ত বক্তব্যের যথার্থতা স্পষ্ট হয়ে উঠে।
১. কর্তৃত্ববাদী সমাজব্যবস্থা : তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর যেসব রাজনৈতিক দল গণতন্ত্রের কথা বলে
সেসব দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা নেই বললেই চলে। মূলত রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে সহিষ্ণুতা, আলোচনা সমঝোতা অনুপস্থিত। ফলে এসব দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ কর্তৃত্ববাদী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় এবং গণতন্ত্র ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
২. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা:
উন্নয়নশীল দেশসমূহে রাজনৈতিক দলসমূহ নিজ নিজ মানমর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য যে কোন প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে দ্বিধাবোধ করে না। তাছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহিঞ্চুতা, আলোচনা ও সমঝোতার অভাবে তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিদ্যমান থাকে। আর এ অস্থিতিশীল রাজনীতির কারণে গণতন্ত্র ফলপ্রসূ হয় না।
৩. আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক দলের অভাব উন্নয়নশীল দেশসমূহে রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে সহিষ্ণুতা, আলোচনা ও সমঝোতার অভাবে সবসময়ে রাজনৈতিক অঙ্গন সমালোচনামুখর থাকে। রাজনৈতিক দলসমূহ কারণে অকারণে একে অন্যের বিরুদ্ধে মিথ্যা বক্তব্য পেশ করে। ফলে রাজনৈতিক দলগুলো আদর্শ বিবর্জিত হয়ে পড়ে।
৪. সুসংগঠিত বিরোধী দলের অভাব: গণতন্ত্রের সফলতার জন্য সুসংগঠিত বিরোধী দল থাকা প্রয়োজন। কেনন
বিরোধী দল সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করে থাকে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশসমূহে সুসংগঠিত বিরোধী দলের অভাব লক্ষ্য করা যায় এবং গণতন্ত্র সফলতা পায় না।
৫. গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাব : রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে সহিষ্ণুতা থাকা আবশ্যক। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল শাসন
করবে কিন্তু সংখ্যালঘুর প্রতি সবসময়ে সহানুভূতি প্রদর্শন করবে। অর্থাৎ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ থাকতে হবে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশসমূহে রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে সহিষ্ণুতা, আলোচনা ও সমঝোতার অভাবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ জাতি হয় না।
৬. জাতীয় ঐকমত্যের অভাব : রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক ধারণা অব্যাহত ও উন্নত করার জন্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জাতীয় ঐকমত্য গঠন করা প্রয়োজন। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশসমূহে রাজনৈতিক দলগুলো একে অন্যকে সহ্য করতে পারে না, ফলে গণতন্ত্র বার বার ব্যর্থ হচ্ছে।
৭. ব্যক্তিস্বাধীনতার অভাব: গণতন্ত্রের সফলতার জন্য ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নান কথা বলা, সিদ্ধান্ত দেয়া, কার্যক্রম নির্ধারণ প্রভৃতি বিষয়ে অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করবে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশসমূহে ব্যক্তিস্বাধীনতার অভাব লক্ষ্য করা যায়, যা গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করে।
৮. নিম্নে রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চা : নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার জন্য উন্নয়নশীল দেশসমূহের রাজনৈতিক দলসমূহ একে অপরের বিরুদ্ধে নানারকম বদনাম প্রচার করে থাকে। যা রাজনীতির সুষ্ঠু বিকাশকে ব্যাহত করে এবং গণতন্ত্রে যাত্রাপথকে কর্দমাক্ত করে। আর এ সবকিছুর মূলে রয়েছে রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে সহিষ্ণুতা, আলোচনা ও
সমঝোতার অভাব।
৯. ক্ষমতাসীন দলের অনমনীয়তা : উন্নয়নশীল দেশসমূহের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, সেখানে ক্ষমতাসীন দল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বিরোধী দলের সাথে আলোচনা ও সমঝোতা না করেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে। অন্য গণতান্ত্রিক সরকারের সফলতার জন্য প্রয়োজন পারস্পরিক আলাপ আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। নতুবা গণতান্ত্রিক সরকার ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।
১০. বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা : গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দল সরকারি দলের সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যে শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করে থাকে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশসমূহে বিরোধী দলসমূহ আলোচনা ও সমঝোতার পরিবর্তে অবাধ সমালোচনা ও বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করে থাকে। ফলে গণতান্ত্রিক সরকারের কার্যকারিতা বিনষ্ট হয়।
১১. একাত্মতার অভাব তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশসমূহের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একাত্মতা অভাব পরিলক্ষিত হয়। রাজনৈতিক দলগুলো আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে একাত্মবন্ধ না হয়ে নিদ্যাবাদী হয়ে উঠে।
১২. ক্ষমতা লিঙ্গা : ক্ষমতা লিপ্সার কারণে উন্নয়নশীল দেশের বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে কার্যকর ভূমিকা রাখার পরিবর্তে ক্ষমতায় যাওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করে। ফলে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিনষ্ট হয়।
১৩. অসংগঠিত ও দলাদলি বিশিষ্ট দলীয় ব্যবস্থা : অসংগঠিত ও দলাদলি বিশিষ্ট দলীয় ব্যবস্থা হলো উন্নয়নশীল দেশের রাজনৈতিক দলীয় ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এখানে রাজনৈতিক দলসমূহ সহিষ্ণুতা, আলোচনা ও সমঝোতার পরিবর্তে দলীয় স্বার্থ নিয়ে তৎপর থাকেন যা গণতান্ত্রিক সরকারের কার্যকারিতাকে কর্দমাক্ত করছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, উন্নয়নশীল দেশসমূহের রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে সহিষ্ণুতা, আলোচনা ও সমঝোতার অভাব সর্বদা বিরাজমান, যা গণতান্ত্রিক সরকারের কার্যকারিতাকে বিপর্যস্ত করে। আর উন্নয়নশীল দেশসমূহে রাজনৈতিক দল ব্যবস্থার বিভিন্ন ত্রুটিবিচ্যুতির কারণে এখানে সুসংগঠিত প্রতিযোগিতামূলক আদর্শভিত্তিক দলীয় ব্যবস্থার উল্ল্যেখ সম্ভব হচ্ছে না। ফলে উন্নয়নশীল দেশে গণতন্ত্রের সঠিক চর্চা ব্যাহত হচ্ছে।