অথবা, গণতন্ত্রে বিরোধী দলের কার্যাবলি কী হওয়া উচিৎ বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে আলোচনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা : “The representative government cannot exist without the opposition.”বর্তমানে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দলের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় অধিকাংশ রাষ্ট্রেই একাধিক দল বিদ্যমান।। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সেই দল সরকার গঠন করে। আর যেসব দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে না, কিন্তু সরকারের অংশ হিসেবে বিশেষ ভূমিকা পালন করে তাকে বিরোধী দল বলে। গণতন্ত্রে বিরোধী দলকে বিকল্প সরকার বলা হয়। বিরোধী দল সরকারি নীতি ও কর্মকাণ্ডের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখে এবং সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহের গঠনমূলক সমালোচনা করে।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দলের ভূমিকা : বর্তমানে যে কোন দেশের শাসনব্যবস্থায় বিরোধী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থায়ও বিরোধী দল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। থাকে। নিম্নে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দলের ভূমিকা আলোচনা করা হলো :
১. গঠনমূলক সমালোচনা : সরকারের প্রতিটি কার্যকলাপের ত্রুটিবিচ্যুতির ভিতগুলো জনসমক্ষে তুলে ধরে সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করাই বিরোধী দলের প্রধান কাজ এবং এ ব্যাপারে বিরোধী দল সদা সচেষ্ট থাকে, এর ফলে সরকারের কাজকর্ম সম্পর্কে জনগণ অবহিত হতে পারে। বাংলাদেশে নির্বাচনে যেসর রাজনৈতিক দল পরাজিত হয় কেনন দল নিষ্ক্রিয় বা বিলুপ্ত হয়ে পড়ে না। ঐসব দল সরকারি নীতি ও কার্যব্যবস্থার সমালোচনা করে বিকল্প কর্মসূচি জনসমকে তুলে ধরে। বিরোধী দলের ভয়ে ক্ষমতাসীন দল ইচ্ছামতো কোন কাজ করতে পারে না।
২. জনমত সংগঠন করা : বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলো তাদের বক্তব্যের সপক্ষে জনমত গঠনে অভিযান চালায়।
এ উদ্দেশ্যে তারা জনসভা, মিছিল, মিটিং ইত্যাদি করে। তাছাড়া সংবাদপত্রে বিবৃতিদান, পুস্তিকা সংকলন ও বিতরণ প্রভৃতি উপায়ে বিরোধী দলগুলো জনমত গঠন করে।
৩. ভোটদানে উৎসাহ প্রদান: নির্বাচনে জয়লাভের আশায় বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলো প্রতিটি ভোটারকে ভোটদানে উৎসাহিত করে, যাতে তাদের সমর্থন দেয়। অনেক সময় বৈধ নাগরিকগণ ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়লে বিরোধী দল তাদেরকে ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তি করায়। তাই বলা হয় যে, বিরোধী দল দ্বারা অনুপ্রাণিত না হলে অনেক ব্যক্তিই ভোটদানে বার্ণ হতো।
৪. জনগণের অধিকার রক্ষা : সরকার যাতে জনগণের অধিকার ক্ষুণ্ণ করার প্রয়াস না পায় বাংলাদেশের বিরোধী দল সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখে। সরকার জনগণের অধিকার ক্ষুণ্ন করলে বিরোধী দল জনগণকে নিয়ে আন্দোলন করবে এবং পরবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনা থাকে বলে সরকার জনগণের অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট হয়।
৫. সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা রোধ: বাংলাদেশে বিরোধী দল জনমত গঠনের মাধ্যমে সরকারের স্বৈরাচারী হওয়ার এবণতাকে রোধ করে। সরকার স্বৈরাচারী কিছু করলে জনসমর্থন হারাবে এবং পরবর্তী নির্বাচনে সরকারি দলের পরাজয়ের সম্ভাবনা থাকে, তাই তারা সংযত থাকে।
৬. সরকারের নিয়ন্ত্রণ: বাধ মূলক ও দায়িত্বশীল মনোভাব নিয়ে সরকারের আপত্তিকর নীতির বিরোধিতা করে এবং সরকারের বিভিন্ন দোষত্রুটি চিহ্নিত করে তখন সরকার বাধ্য হয়ে বিভিন্ন বিষয়ে তদন্ত কমিটি বা কমিশন গঠন করে। বিভিন্ন কার্যাবলির মাধ্যমে বিরোধী দল সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা পালন করে।বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এসব বিষয় লক্ষনীয়।
৭. গণতন্ত্র রক্ষার অগ্রদূত: গণতন্ত্রে বিরোধী দলের বিশেষ ভূমিকা আছে। বিরোধী দল ছাড়া স্বৈরশাসন চলতে পারে কিন্তু গণতন্ত্র পারে না। গণতন্ত্রের জন্য বিরোধী দল একান্ত আবশ্যক। সেজন্যই মিল বলেছেন যে, “যেখানে বিরোধী দল নেই সেখানে গণতন্ত্র নেই।” শক্তিশালী বিরোধী দল থাকলে গণতন্ত্রের ধারা ব্যাহত হয় না। আর একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশে বিরোধী দলের ভূমিকা অত্যধিক।
৮. বিকল্প ইশতেহার প্রদান: বিরোধী দল সরকারি কর্মসূচির পাশাপাশি জনগণের সামনে তাদের নিজেদের ইশতেহার প্রদান করে। ফলে জনগণ একের অধিক কর্মসূচির মধ্যে যে কোন একটিকে বেছে নেয়ার সুযোগ পায় এবং অধিক যুক্তিযুক্ত কর্মসূচিকে সমর্থন জানায়।
৯. আইন প্রণয়নে সাহায্য করে : বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো বাংলাদেশেও আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে
বিরোধী দল সরকারি দলকে প্রয়োজনীয় সাহায্য সহযোগিতা করে থাকে। সরকারি দল যখন আইন প্রণয়ন করে তখন বিভিন্ন সম্পূরক প্রশ্নের মাধ্যমে বিরোধী দল আইন প্রণয়নে সহায়তা করে থাকে। তাছাড়া আইনসভার কাজ যাতে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয় তার জন্য বিরোধী দল অনন্য ভূমিকা পালন করে।
১০. বিকল্প সরকার : বিরোধী দলকে বিকল্প সরকার বলা হয়ে থাকে। ক্ষমতাসীন সরকারের কোন দুর্বলতা দেখা দিলে বিরোধী দল বিকল্প সরকার গঠনের চিন্তাভাবনা করে। বিরোধী দল সরকারের প্রতিটি দুর্বলতার সুযোগ নেয়ার জন্য সদা তৎপর থাকে। সর্বোপরি বিরোধী দল বিকল্প সরকার হিসেবে কাজ করে।
১১. সমস্যা নির্ধারণ ও প্রতিকার: ক্ষমতাসীন সরকারের ব্যর্থতা জনসমক্ষে তুলে ধরার জন্য বিরোধী দল বিভিন্ন জাতীয় সমস্যা চিহ্নিত করে এবং তার প্রতিকারের পদ্ধতি বর্ণনা করে। এ কাজগুলো বিরোধী দল জনসমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে খুব গুরুত্বসহকারে সমাধা করে। ফলে অনেক সুপ্ত সমস্যা চিহ্নিত হয় এবং সরকারের পক্ষ থেকে তা সমাধানের আশ্বাস পাওয়া।
১২. জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা : গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তথা বাংলাদেশে বিরোধী দল জাতীয় সংহতি বা ঐকমতা প্রতিষ্ঠার
জন্য সচেষ্ট থাকে। পরবর্তী নির্বাচনে জয়লাভের আশায় সরকারের বিভিন্ন কার্যাবলির সমালোচনাকালে জনগণকে বিভিন্ন মিটিং, মিছিল এবং অন্যান্য কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে হয়। এতে জাতীয় সংহতি এবং ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
উপসংহার : উপযুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বাংলাদেশের মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশে বিরোধী দলের ভূমিকা মার্জিত ও
প্রসংশনীয় হওয়া উচিত। এমন কোন আচরণ সংসদে করা উচিত নয়, যা জাতীয় জীবনে অমঙ্গলজনক। তাছাড়া সরকারি দলেরও উচিত বিরোধী দলের সাথে নমনীয় আচরণ করা। সর্বোপরি গণতন্ত্র রক্ষা ও সরকার নিয়ন্ত্রণের জন্য বিরোধী দলের ভূমিকা অনস্বীকার্য।