গণতন্ত্রে দলীয় ব্যবস্থা কি অপরিহার্য? পর্যালোচনা কর।

রকেট সাজেশন
রকেট সাজেশন

অথবা, গণতন্ত্রে দলীয় ব্যবস্থার গুরুত্ব আলোচনা কর।
অথবা, গণতন্ত্রে দলীয় ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা : “A political party is an association organized in support of some principles or policies which by, through constitutional means, it endeavours to make the determinant of the government.”
বর্তমান বিশ্বের প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা অত্যন্ত রুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক দল ব্যতীত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কথা কল্পনা করা যায় না। রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব আজ সর্বজনস্বীকৃত। দল ব্যবস্থা বর্তমান প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থার এক অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। মূলত রাজনৈতিক দলের সাহায্যেই দেশের শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হয়। এটা জনমত গঠনের একটি প্রকৃষ্ট উপায়। রাজনৈতিক দল দেশের নির্বাচকমণ্ডলী এবং সরকারের মধ্যে এক অপরিহার্য সেতুবন্ধনস্বরূপ অবস্থান করে। তাই যে কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা ও কার্যাবলি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

গণতন্ত্রে দলীয় ব্যবস্থা অপরিহার্য কি না: আধুনিক গণতন্ত্র রাজনৈতিক দলের উপর নির্ভরশীল।রাজনৈতিক দল ব্যতীত গণতন্ত্রের কথা কল্পনা করা যায় না। রাজনৈতিক দলই গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থাকে কার্যকর করে তোলে। নির্বাচন থেকে শুরু করে সরকার গঠন, শাসনব্যবস্থা পরিচালনা এবং জনমত সংরক্ষণ সকল কাজ দলের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার রাজনৈতিক দলের নানাবিধ কার্যাবলির গুরুত্ব তার অস্তিত্বের অপরিহার্যতাকে সুদৃঢ় করে। গণতন্ত্রে দলীয় ব্যবস্থা যে অপরিহার্য তা নিম্নে আলোচনা করা হলো।

১. জনমত গঠন : গণতন্ত্রের প্রকাশ স্বরণ হলো জনমত। আর রাজনৈতিক দল জনমত গঠনের বাহন হিসেবে কাজ করে। রাজনৈতিক দল এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সুস্পষ্টভাবে প্রণয়ন করার পর স্বীয় বক্তব্যের সপক্ষে জনমত গঠনের জ অভিযান পরিচালনায় লিপ্ত হয়। প্রচারণার সকল মাধ্যম কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক দল জনসভা অনুষ্ঠান, পুস্তিকা সংকলন ও বিতরণ, নির্বাচনে আকর্ষণীয় প্রার্থীদের মনোনয়ন দান প্রভৃতি উপায়ে এর কর্মসূচির প্রতি নাগরিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ ও আগ্রহ আত করার জন্য কর্মতৎপর হয়।

২. সরকার গঠন : প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের প্রধান কাজ ও লক্ষ্য হলো সরকারি ক্ষমতা দখল ও সরকার গঠন করা। নির্বাচনে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, সে দল সরকার গঠন করে এবং নির্বাচনপূর্ব প্রদত্ত প্রতিশ্রুতিগুলো পালনের চেষ্টা করে। সরকার গঠন করার মাধ্যমেই রাজনৈতিক দলগুলো নিজ নিজ দলীয় নীতি ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার সুযোগ লাভ করে।

৩. রাজনৈতিক চেতনা ও শিক্ষার প্রসার : সাধারণ ভোটারদের রাজনৈতিক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা রাজনৈতিক দলের অপর একটি উল্লেখযোগ্য কাজ। উদারনৈতিক গণতন্ত্রে প্রতিটি রাজনৈতিক দলই নিজ নিজ দলীয় নীতি ও কর্মসূচির পক্ষে প্রচারণা চালায়। জনসমর্থন পাওয়ার জন্যই এরূপ প্রচারণা চালানো হয়, এর ফলে জনগণের উদাসীনতা ও অজ্ঞতা দূর হয়। জনগণের রাজনৈতিক চেতনা ও শিক্ষার প্রসার ঘটে।

৪. প্রার্থী মনোনয়ন: প্রার্থী মনোনয়ন ও ভোট সংগ্রহ করাও রাজনৈতিক দলের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। রাজনৈতিক দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য প্রার্থী মনোনয়ন করে এবং প্রার্থীর সপক্ষে ভোট সংগ্রহের চেষ্টা করে। সাধারণত নম্র, ভদ্র, বিনয়ী, শিক্ষিত, জ্ঞানী, বিত্তবান, নিঃস্বার্থ ও পরোপকারী প্রভৃতি গুণাবলিসম্পন্ন ব্যক্তিকেই নির্বাচনের প্রার্থীরূপে মনোনয়ন করা হয়ে থাকে।

৫. বিকল্প কর্মসূচি পেশ করা : জনগণের নিকট বিকল্প কর্মসূচি পেশ করা বিরোধী দলের একটি অন্যতম ভূমিকা। সাধারণত নির্বাচনের পূর্বে বিরোধী দলের বা রাজনৈতিক দলের পক্ষ হতে এ ধরনের বিকল্প কর্মসূচি জনসমক্ষে প্রচার করা হয়। ফলে জনগণ দুই বা ততোধিক কর্মসূচির মধ্যে কোনটি উত্তম তা বেছে নিতে পারে।

৬. গণতান্ত্রিক পন্থার সাকার পরিবর্তন : জনগণের স্বার্থবিরোধী কাজে লিপ্ত হলে পরবর্তী নির্বাচনে ন‍ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলকে নির্বাচিত না করে অন্য কোন দলকে ক্ষমতায় বসাতে পারে। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার বদল করা যায়। রাজনৈতিক দলই শান্তিপূর্ণ উপায়ে সরকার পরিবর্তন করা সম্ভবপর করে তোলে। ফলে সরকার পরিবর্তনের উপায় হিসেবে সশস্ত্র বিপ্লব বা কোনরূপ অভ্যুত্থানের প্রয়োজন হয় না।

৭. জাতীয় ঐক্যবোধ সৃষ্টি : উদারনৈতিক গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলগুলো বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে দলীয় নীতি এ কর্মসূচি প্রণয়ন করে। ফলে ধর্ম, বর্ণ ও জাতিগত সংকীর্ণ স্বার্থ বা মনোবৃত্তি গড়ে উঠতে পারে না।

৮. স্বৈরাচারিতা প্রতিরোধ : রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ কোন দল বা গোষ্ঠীর স্বৈরাচারী কার্যকলাপ জনসমক্ষে তুলে ধরে, এর ফলে ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষে গণবিরোধী ও স্বেচ্ছাচারী কার্যকলাপে লিপ্ত হওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। এমনকি কোন বিরোধী দলের পক্ষেও একনায়কতান্ত্রিক বা স্বৈরাচারী শাসন পদ্ধতির পক্ষে প্রচারণা চালানো সম্ভব হয় না।

৯. আইন ও শাসন বিভাগের মধ্যে সহযোগিতা সৃষ্টি : সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের মধ্যে প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা যায়। আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলই সরকার গঠন করে। ফলে উভয় বিভাগের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়, এর ফলে প্রশাসনিক উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পায়।

১০. গণতন্ত্রের স্বরূপ সংরক্ষণ : গণতন্ত্রকে জনমতের শাসনব্যবস্থা বলে অভিহিত করা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন প্রাপ্ত সরকারি দল জনমতকে বাস্তবে রূপায়িত করার ব্যাপারে আত্মনিয়োগ করে। এভাবে দলপ্রথা গণতান্ত্রিক স্বরূপ বজায় রাখে।

W. B. Munro মন্তব্য করেছেন, “Now here has there ever been free government without political parties.

১১. সরকারের স্থায়িত্ব রক্ষা: সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করে। ফলে সরকারের স্থায়িত্বের ব্যাপারে দুশ্চিন্তা থাকে না। তাই সরকারও সুশাসন ও জনকল্যাণ সাধনে পরিপূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করতে পারে।

১২. সরকার ও জনগণের মধ্যে সংযোগ সাধন : রাজনৈতিক দলই সরকার ও জনগণের মধ্যে সংযোগ সাধন করে
থাকে। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের অভাব অভিযোগের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো সরকারকে অবহিত করে এবং এসব সমস্যাদির সমাধান এবং অভাব অভিযোগ নিরসনের জন্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে। তার ফলে জনস্বার্থ সংরক্ষণে সরকারকে বাধ্য হতে হয়।

১৩. সমস্যা নির্বাচন : আধুনিক রাষ্ট্রগুলো আয়তনে যেমন বিশাল, জনসংখ্যাও তেমনি বিপুল। এসব রাষ্ট্রের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যাও অসংখ্য এবং বিচিত্র প্রকৃতির। আর রাজনৈতিক দলগুলো এরূপ অসংখ্য ও জটিল সমস্যা নির্ণয় করে তার আশু সমাধানের চেষ্টা চালায়।

উপসংহার : উপযুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা অনস্বীকার্য। দল ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার স্বরূপ বজায় রাখে। প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে কার্যকর করার জন্য রাজনৈতিক দল অপরিহার্য। অধ্যাপক গেটেল বলেছেন, “যেখানে সুসংহত পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক দল রয়েছে সেখানে সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক অবস্থা বিদ্যমান বলে বিশ্বাস করা হয়। সুতরাং গণতন্ত্রে দলীয় ব্যবস্থা অপরিহার্য।