একদলীয় ব্যবস্থার দোষাবলি আলোচনা কর।

রকেট সাজেশন
রকেট সাজেশন

অথবা, একদলীয় ব্যবস্থার কুফল আলোচনা কর।
অথবা, একদলীয় ব্যবস্থার অসুবিধাসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, একদলীয় ব্যবস্থার নেতিবাচক দিকসমূহ আলোচনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা : বর্তমান বিশ্বের প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক দেশে দল ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব আজ সর্বজনস্বীকৃত। যেসব দল ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে তার মধ্যে একদলীয় ব্যবস্থা অন্যতম। একদলীয় ব্যবস্থার একটি মাত্র দলটি তার আদর্শ রীতি ও কর্মসূচি অনুসারে শাসনকার্য পরিচালনা করে থাকে। একদলীয় ব্যবস্থায় কিছু কিছু গুণের পাশাপাশি দোষত্রুটি বিদ্যমান।একদলীয় ব্যবস্থার দোযাবলি একদলীয় ব্যবস্থার ভালো নিকের পাশাপাশি খারাপ দিকও রয়েছে। নিম্নে এর দোষাবলিসমূহ আলোচনা করা হলো।

১. ব্যক্তিস্বাধীনতার বিরোধী : একদলীয় ব্যবস্থায় একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ফলে ব্যক্তিস্বাধীনতা বিপর্যন্ত হয়। এবং স্বাধীন চিন্তার পথ রুদ্ধ হয়। চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলে স্বাধীনতাই অর্থহীন হয়ে পড়ে। স্বাধীন পরিবেশ ছাড়া ব্যক্তিজীবনে স্বাভাবিক বিকাশ অসম্ভব। একদলীয় ব্যবস্থায় তা সম্ভব হতে পারে না। অধ্যাপক দেবেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী (D. N. Banerjee) বলেছেন, “Liberty of thought and discussion which is so fundamental to democracy cannot exist in a none party state”

২. গণতন্ত্র বিরোধী : একদলীয় শাসনে নানারকম মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে জনগণকে প্রভাবিত করা হয়। জনগণ কোন বিষয়ে সঠিক তথ্য জানতে পারে না। তাদের চিন্তা মানসিকতার স্বাধীন বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। তাদের রাজনৈতিক অধিকার ও চেতনা নিয়ন্ত্রিত হয়। তাই একদলীয় ব্যবস্থা গণতন্ত্র বিরোধী।

৩. জনমত সৃষ্টি হয় না : রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তি হলো জনমত কিন্তু একদলীয় শাসনে জনমতের গঠন এবং বিকাশ সাধন হয় না এবং এর কোন প্রাধান্য থাকে না। দলের প্রতি সমর্থন দেয়াই জনগণের কাজ এবং এর বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করার কোন অবকাশ নেই। জনগণ ভিন্ন কোন মত প্রকাশ করতে পারে না। এ পরিস্থিতিতে জনমত গঠন ও প্রতিফলিত হওয়া অসম্ভব। এমনকি তারা নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটি মাত্র দলকে সমর্থন বা ভোট প্রদান করতে বাধ্য হয়।
শাসনকার্যে জনগণ যে সক্রিয় হতে পারে একদলীয় কার্যক্রমে তা মনেই করা হয় না।

৪. স্বৈরাচারী সরকার: যে শাসনব্যবস্থায় বিরোধী দলের অস্তিত্ব অস্বীকৃত এবং সমালোচনার সুযোগ নেই, সেই শাসনব্যবস্থায় সরকার নিশ্চিতভাবেই স্বৈরাচারী হবে। অধ্যাপক জেনিংস (Jennings) মন্তব্য করেছেন, “If there is no opposition there is no democracy বিরোধী দলই সরকারি কার্যকলাপের গঠনমূলক সমালোচনা করে। ফলে সরকার সঠিক পথে থাকতে বাধ্য হয়। অন্যথায় সরকার স্বৈরাচারী হবেই।

৫. বিপ্লবের আশঙ্কা: দেশে বহু রাজনৈতিক দল থাকলে জাতীয় ঐকা ক্ষুণ্ণ হয় বলে যে মুক্তি দেখানো হয় তা সঠিক নয়। বরং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল জনগণের ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা ও আশা-আকাঙ্ক্ষাকে প্রকাশিত করে বলে জনসাধারণের মধ্যে ক্ষোভ সঞ্চারিত বা পুঞ্জীভূত হতে পারে না। ফলে বিপ্লবের আশঙ্কা থাকে না। কিন্তু একদলীয় ব্যবস্থায় বিপ্লবের আশঙ্কা থাকে।

৬. ব্যক্তিত্বের বিনাশ : একদলীয় শাসনে ব্যক্তিত্বের বিনাশ ঘটে। কারণ একদলীয় ব্যবস্থায় স্বাধীন চিন্তার পরিবেশ থাকে না। একদলীয় রাষ্ট্রে একটি নির্দিষ্ট ধাঁচে বা পথে ব্যক্তির চিন্তাচেতনা, ধ্যানধারণা, কাজকর্ম সবই নিয়ন্ত্রিত হয়। এ রকম কৃত্রিম বা যান্ত্রিক পরিবেশ মানব প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যহীন। এতে ব্যক্তিমানুষের ব্যক্তিত্বের স্বাধীন বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়, ব্যক্তিত্বের অপমৃত্যু ঘটে।

৭. অধিকার খর্ব : নাগরিকদের পূর্ণ অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করা হয় না। তাদের সমালোচনা করা বা বিরোধী মতবাদ প্রকাশের কোন অধিকার নেই। দলীয় শৃঙ্খলা বিধানের নামে সুকৌশলে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার খর্ব করা হয়।

৮. দমনমূলক শাসন: একদলীয় শাসনে দমনমূলক শাসন প্রবর্তিত থাকে। কোন দল বা জনগণ উক্ত দলের মতাদর্শের বিপক্ষে মত প্রকাশ করলে যে কোন প্রক্রিয়া অবলম্বনে তাদের দমন করা হয়। “একদল থাকলে ক্ষমতা একচেটিয়াভাবে নিজেদের দখলে রাখে। তাছাড়া একদলীয় শাসনে আইনসভা প্রাণবন্ত হয় না।

৯.প্রার্থী বাছাইয়ের সুযোগ নেই: একদলীয় ব্যবস্থার ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে জনগণ প্রতিনিধি বাছাই করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। ঐ একটি দল যে প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয় তাকেই ভোট দিতে হয়। এতে জনসাধারণ প্রতিনিধি
বাছাই করার সুযোগ পায় না এবং প্রার্থীদের যোগ্যতাও বিচার করা হয় না।

১০. সাম্য ও সমানাধিকার অস্বীকৃত: একদলীয় ব্যবস্থায় সাম্য ও সমানাধিকারের নীতি আস্থাশীল নয়। এরূপ শাসনব্যবস্থায় মুষ্টিমেয় মানুষ দেশ শাসন করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে বিনা প্রতিবাদে তাদের শাসন মেনে নিতে হয়।

১১. দলই প্রধান : একদলীয় শাসনব্যবস্থায় দলই সবকিছু। দেশ ও মানুষের কোনই মূল্য এখানে নেই। দলের জন্য রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের জন্য দল নয়। দল আগে, রাষ্ট্র পরে। ফলে এরূপ একদলীয় শাসনব্যবস্থা বর্বর শাসনব্যবস্থা হিসেবে মূল্যায়িত হয়।

উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার জন্য রাজনৈতিক দল অপরিহার্য। আর একদলীয় শাসনব্যবস্থায় গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। তাই আধুনিক বিশ্বে একদলীয় শাসনব্যবস্থা বা নল ব্যবস্থাকে কেউ সমর্থন করে না। কেননা একদলীয় ব্যবস্থা স্বৈরাচারের নামান্তর। রাজনৈতিক দলই সরকারি কার্যকলাপের গঠনমূলক সমালোচনা করে, সরকারকে সঠিক পথে থাকতে বাধ্য করে। এ কারণে একদলীয় শাসনব্যবস্থার অস্তিত্ব বর্তমান বিশ্বে তেমন একটা দেখা যায় না।