অথবা, সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের নেতিবাচক দিক আলোচনা কর।
অথবা, সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের অসুবিধা আলোচনা কর।
উত্তর: ভূমিকা : ভোটাধিকার নাগরিকদের অন্যতম রাজনৈতিক অধিকার। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সর্বজনীন ভোটাধিকার একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায়। অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে থাকে। আধুনিক রাষ্ট্র বিশাল এলাকা ও বিরাট জনসমষ্টির সমন্বয়ে গঠিত। সুতরাং প্রত্যক্ষভাবে জনগণের আইন প্রণয়ন ও শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করা আজ সম্ভবপর নয়। তাই বর্তমানে জনগণ পরোক্ষভাবে ভোটদানের মাধ্যমে আইন প্রণয়ন ও শাসন বিভাগের অন্যান্য কার্যে অংশগ্রহণ করে। ভোটদানের মাধ্যমে জনগণ তাদের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোটাধিকার হলো নাগরিকদের একটি মৌলিক অধিকার।
সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের বিপক্ষে যুক্তি : সর্বজনীন ভোটাধিকারের উপর্যুক্ত গুণাবলি সত্ত্বেও বিভিন্ন সময় নানা যুক্তির ভিত্তিতে এ অধিকারকে কঠোরভাবে সমালোচনা করা হয়েছে। লর্ড মেকলে, লেকি, হেনরি মেইন, জন স্টুয়ার্ট মিল এ ভোটাধিকারের বিরোধিতা করেছেন।
১. বিপজ্জনক : সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রদান রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। যে ব্যক্তি ভোটের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারবে না তাকে ভোটাধিকার প্রদান রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর নাও হতে পারে। অন্ধকে বাইনোকুলার এবং শিশুকে আগুন ব্যবহার করতে দেয়া নিতান্তই বোকামি এবং তা কোন সময়ে মঙ্গলকর হতে পারে না। তেমনি অশিক্ষিত ও অজ্ঞ ব্যক্তিদের ভোটদানের অধিকার প্রদান যুক্তিযুক্ত নয় এবং তারা ভোট যথার্থ প্রদান করতে সক্ষম হবে না।
২. ভোটাধিকার জন্মগত অধিকার নয় : ভোটাধিকার নাগরিকদের জন্মগত অধিকার নয়, এ অধিকার রাষ্ট্রই নাগরিকদের প্রদান করে থাকে। তাই এ অধিকার সকলকে দেয়া ঠিক নয়। যোগ্যতা বলে অর্জনে ব্যর্থ হলে অধিকার প্রদান বাঞ্ছনীয়। ভোটাধিকার পবিত্র অধিকার এবং এক প্রবল শক্তি, একে তাচ্ছিল্যভরে দেখা ঠিক নয়। সেজন্য যোগ্যতাবান
ব্যক্তিদেরই এ অধিকার থাকা যুক্তিযুক্ত।
৩. নাগরিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ : সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের নীতি ভোটদানের ব্যাপারটিকে প্রহসনে পরিণত করে। দরিদ্র, অনগ্রসর দেশের জনসাধারণ ভোটদানের পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব উপলব্ধি করতে অক্ষম। নানারূপ আর্থিক প্রলোভনের শিকার হয়ে তারা নাগরিকের দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হন। রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন প্রার্থীরা নির্বাচকদের দারিদ্রোর সুযোগ নিয়ে নানারূপ অনৈতিক ক্রিয়াকলাপে লিপ্ত হয়ে ভোট সংগ্রহ করতে তৎপর হন।
৪. জনমত প্রতিফলিত হয় না : গণতন্ত্রে জনমতের গুরুত্ব অপরিসীম। সর্বজনীন ভোটাধিকারের বিরোধিগণ এ অভিমত ব্যক্ত করেন যে, নির্বাচনের মাধ্যমে জনমত প্রতিফলিত হয় না। সর্বজনীন ভোটাধিকার স্বীকৃত দেশে বহুসংখ্যক মানুষ আছেন, জনমত গঠনের ক্ষেত্রে যাদের কোন অবদান ছিল না। বিভিন্ন ব্যক্তি এবং সংগঠনের নির্দেশ অনুযায়ী তারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। সুতরাং তাদের ভোটের মাধ্যমে প্রকাশিত মতামত কোনভাবেই জনমতে পরিণত হতে পারে না। ব্লুন্টসলির মতে, “অক্ষম ও অযোগ্যদের হাতে শাসন নির্বাচনের ক্ষমতা অর্পণ রাষ্ট্রের পক্ষে আত্মহত্যার সমান।
৫. নারীদের বা স্ত্রীলোকদের ভোটাধিকার প্রদান যুক্তিযুক্ত নয় : অনেকে নারী জাতির ভোটাধিকার প্রদানের বিপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেছেন। নারীদের ভোটাধিকার প্রদান করলে সংসার জীবনে নানা জটিলতা দেখা দিবে। তাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞাও কম, তাই একই নীতিতে ভোটাধিকার প্রদান অনুচিত।
৬. সম্পত্তিহীন ব্যক্তি রাষ্ট্রদরদি নয় : সর্বজনীন ভোটাধিকারের বিরোধিতা করে বহু রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সম্পত্তির মালিকানা এবং কর প্রদানকে ভোটাধিকারের ভিত্তিস্বরূপ গণ্য করেছেন। জন স্টুয়ার্ট মিল, লেকি, হেনরি মেইন, সিজউইক, রুন্টসলি এবং আরো বহু রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এ মতের পৃষ্ঠপোষক। তাদের মতে, কিছু পরিমাণ সম্পত্তির মালিক না হলে কোন নাগরিককে ভোটাধিকার দেয়া উচিত নয়। কারণ সম্পত্তির মালিকানার অধিকারী না হলে রাষ্ট্রের কল্যাণের সাথে ব্যক্তির স্বার্থ ওতপ্রোতভাবে জড়িত হতে পারবে না বলে সম্পত্তিবিহীন ব্যক্তি রাষ্ট্রের প্রতি দরদি হবেন না। অতএব সম্পত্তিবিহীন নাগরিকদের ভোটদানের অধিকার দেয়া অনুচিত। John Stuart Mill এর কথায়, “Those who pay notaxes.অন্য মানুষের অর্থ তাদের ভোটের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার প্রতিটি উদ্দেশ্যই বিলাসবহুল হওয়ার এবং কোনটিই অর্থনৈতিক হওয়ার নয়।”
৭. বর্ণবিদ্বেষ নীতি : কোন কোন দেশে আবার ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদিকেও ভোটাদানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হয়।এককথায়, বহু দেশে বহু মানুষের মধ্যে এরূপ ধারণার প্রচলন আছে যে, ভোটদানের অধিকার সর্বজনীন না হয়ে বর্ণ, ধর্ম,রক্তের বিশুদ্ধতা এবং জাতপ্রথার উপর নির্ভরশীল হলে ভালো হয়। উৎকৃষ্টতর শাসনব্যবস্থা একমাত্র উৎকৃষ্টতর মানুষেরাই গড়ে তুলতে পারে, সর্বজনীন ভোটাধিকার উৎকর্ষের বিচার না করে সকল নরনারীকে ভোটাধিকার দিয়ে উৎকৃষ্ট শাসনের মূলে কুঠারাঘাত করে।
৮. মধ্যবিত্ত শ্রেণিই প্রকৃত ভোটদানের যোগ্য : সমাজবিজ্ঞানের একটি তত্ত্বের অপব্যাখ্যা করে কতিপয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। এরূপ ধারণা প্রচার করেছেন যে, অভিজাত ও তথাকথিত নিম্নশ্রেণীগুলো জাতীয় শিক্ষা, সংস্কৃতির প্রতি একনিষ্ঠ না হয়ে। নিজ নিজ প্রয়োজনের তাগিদে বিজাতীয় ধ্যানধারণায় অভ্যস্ত হয়ে উঠতে কুণ্ঠিত হয় না। অর্থাৎ এরূপ শ্রেণিগুলোর ধ্যানধারণা ও জীবনদর্শনের কোন স্থায়িত্ব নেই। অথচ মধ্যবিত্ত শ্রেণিগুলোর ধ্যানধারণা ও জীবন দর্শনের স্থায়িত্ব সকল দেশেই লক্ষ্য করা যায়। এরূপ কারণ দেখিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন, একমাত্র মধ্যবিত্ত শ্রেণিভুক্ত মানুষদেরই সার্বিক ভোটাধিকার থাকা উচিত, অন্যান্য শ্রেণিভূক্ত সকল মানুষের নয়।
৯. উচ্ছৃঙ্খল জনতার শাসন কায়েম : সর্বজনীন ভোটাধিকার গণতন্ত্রকে উচ্ছৃঙ্খল জনতার শাসনে পরিণত করবে। অজ্ঞ, মূর্খ ও অবিবেচক জনগণের ভোটাধিকার চর্চা করার যোগ্যতা নেই। গণতন্ত্রের নামে তাদের ক্ষেত্রে ভোটাধিকার সম্প্রসারণ করা হলে দেশকে আবেগ, উচ্ছৃঙ্খলতা ও অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দেয়া হবে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের বিপক্ষে প্রসিদ্ধ পণ্ডিতদের উপর্যুক্ত যুক্তি সত্ত্বেও এটা আধুনিক যুগের পরোক্ষ গণতন্ত্রের ভিত্তিস্বরূপ। ভোটাধিকার চর্চার মাধ্যমেই কেবল প্রত্যেক ব্যক্তির নাগরিকতার পূর্ণবিকাশ সম্ভব। নাগরিক প্রাপ্তবয়স্ক হলে রাজনীতি সচেতন হবে বলে সাধারণভাবে প্রত্যাশা করা যায়। আর তখন তাকে ভোটাধিকার প্রদান করা আবশ্যক। সর্বজনীন ভোটাধিকার ব্যতীত গণতন্ত্রের বাস্তবায়ন সম্ভবপর হয় না। বাংলাদেশে প্রথম থেকেই প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়েছে।