অথবা,সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের সুবিধাসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ইতিবাচক ভূমিকা আলোচনা কর।
উত্তর: ভূমিকা : ভোটাধিকার নাগরিকদের অন্যতম রাজনৈতিক অধিকার। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সর্বজনীন ভোটাধিকার একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে থাকে। আধুনিক রাষ্ট্র বিশাল এলাকা ও বিরাট জনসমষ্টির সমন্বয়ে গঠিত। সুতরাং প্রত্যক্ষভাবে জনগণের আইন প্রণয়ন ও শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করা আজ সম্ভবপর নয়। তাই বর্তমানে জনগণ পরোক্ষভাবে ভোটদানের মাধ্যমে আইন প্রণয়ন ও শাসন বিভাগের অন্যান্য কার্যে অংশগ্রহণ করে। ভোটদানের মাধ্যমে জনগণ তাদের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোটাধিকার হলো নাগরিকদের একটি মৌলিক অধিকার।
সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের পক্ষে যুক্তি : সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নীতিতে পরিণত হয়েছে। ভিক্টর হুগোর মতে, “সার্বিক ভোটাধিকার মানুষকে রাজমুকুটে ভূষিত করে নাগরিকত্ব দান করেছে।” তিনি বলেছেন, “Adult suffrage has crowned man as citizen.” সাধারণভাবে সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের পক্ষে যেসব যুক্তি দেখানো হয়, তা হলো :
১. গণ-সার্বভৌমিকতার যুক্তি : গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সার্বভৌম শক্তি জনগণের মধ্যে নিহিত থাকে। এ শক্তি ব্যবহারের অধিকার প্রত্যেক নাগরিকেরই আছে। এ অধিকার স্বাভাবিক বা অনুগত। ভোট দেয়ার জন্মগত অধিকারই হলো এর অপরিহার্য পরিণতি। প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্রে সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের মাধ্যমে এ গণ-সার্বভৌমিকতা বাস্তবে রূপায়িত হয়। Appadorai বলেছেন, “The primary means by which the people exercise their sovereignty is the vote.”
২. একটি বিশেষ শক্তি : গণতন্ত্র বলতে জনগণের শাসনকে বুঝায়। তাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ এবং আইন প্রণয়নের ব্যাপারে সকলের সমান অধিকার থাকা দরকার। সরকারি আইনকানুন সকলকেই প্রভাবিত করে। তাই সকলের ভোটাধিকার থাকা চাই। ভোটাধিকার জনগণের একটি বিশেষ শক্তি। এ শক্তির দ্বারাই ব্যক্তি সরকারের আইন প্রণয়নকে প্রভাবিত করতে পারে।
৩. শাসকের স্বৈরাচারিতা রোধ : প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার না থাকলে শাসকগোষ্ঠী স্বৈরাচারী হতে বাধ্য। এ অধিকারের স্বীকৃতি থাকলে তা সম্ভব হয় না, কারণ তাদের স্পষ্ট জানা থাকে যে, যদি জনসাধারণের স্বার্থের প্রতিকূলে কাজ করে, তাহলে পরবর্তী নির্বাচনে জনগণ কোন সময়ে সমর্থন দিবে না। জনসমর্থন লাভের জন্য শাসকগোষ্ঠী স্বৈরাচারী পন্থায় দেশ শাসন করতে সাহস পায় না।
৪. শাসক নির্বাচন : রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সরকার প্রয়োজন। শাসনযন্ত্র পরিচালিত হয় সরকারের দ্বারা। সরকারের শাসন দেশের মধ্যে বসবাসকারী জনগণের জন্য সমান প্রযোজ্য। তাই শাসক নির্বাচনের দায়িত্ব সর্বসাধারণের উপর অর্পিত হবে তাতে কোন যুক্তির অবতারণা করার প্রয়োজন হয় না। লাস্কির কথায়, “There is no permanent right to power.” সুতরাং ভোটাধিকার প্রাপ্ত হলে জনগণ ভোট দিয়ে সরকার পরিবর্তন করতে পারে।
৫. সম্মান লাভ : ভোটাধিকারপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সরকার সম্ভ্রমের চোখে দেখে এবং বিশেষ মর্যাদা দেয়। ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত ব্যক্তিদের স্বার্থ অবহেলিত হয়। ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হওয়ার অর্থ হলো ক্ষমতাপ্রসূত সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়া (Exclusion from power means exclusion from benefit of power )।
৬. রাজনৈতিক সচেতনতা : ভোটাধিকার প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে জনসাধারণের মধ্যে রাজনৈতিক শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি পায় এবং জনগণ অধিক পরিমাণে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়। নির্বাচনের সময়ে প্রত্যেক রাজনৈতিক দল দেশের পরিস্থিতি ও অন্যান্য সমস্যাদি সম্পর্কে নিজেদের মতামত জনসমক্ষে তুলে ধরে। বিভিন্ন দলের কার্যক্রম ও নীতির তুলনামূলক আলোচনা জনসাধারণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার ব্যাপক বিস্তার ঘটায়।
৭. সুনাগরিক হতে সহায়তা করে : সার্বিক ভোটাধিকার না থাকলে রাষ্ট্রনীতি সচেতন সুনাগরিক সৃষ্টি করতে পারে না। একটি জাতির উন্নতি সম্ভব যদি সকল স্তরের জনসাধারণের মধ্যে দেশাত্মবোধ জাগ্রত হয়। এ ভাবধারা তখনই মূর্ত হয় যখন অংশীদারিত্ব থাকে। জনসাধারণ ভোটদানে শাসন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারে। তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে দেশপ্রেম আশা বাতুলতা মাত্র।
৮. সকল অংশের স্বার্থ সংরক্ষণ : সর্বজনীন ভোটাধিকার সমাজের সকল অংশের স্বার্থ সংরক্ষণের অনুকূল
ভোটাধিকারকে সীমিত করা হলে সমাজের অন্যান্য অংশের মতামত প্রকাশ এবং স্বার্থরক্ষার কোন অবকাশই থাকবে না । সর্বজনীন ভোটাধিকার ব্যতীত সমাজের সকল অংশের বক্তব্য অনুধাবন এবং স্বার্থ সংরক্ষণ সম্ভব নয়।
৯. কল্যাণ লাভ : গণতন্ত্র বলতে যদি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত, জনগণের দ্বারা পরিচালিত এবং জনগণের কল্যাণে পরিচালিত কোন ব্যবস্থাকে বুঝান হয়, তাহলে সর্বজনীন ভোটাধিকার অপরিহার্য। জনগণের জীবনের সাথে প্রতিটি রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপ জড়িত। সুতরাং জনগণের ভোটাধিকার সীমিতকরণের দ্বারা তাদের কল্যাণসাধন সম্ভব নয়।
১০. শ্রেণিসংঘাত রোধ : ভোটাধিকার সর্বজনীন না হলে শ্রেণিসংঘাতের সৃষ্টি হবে। ভোটাধিকার বঞ্চিত জনগণ সরকারি সুযোগ সুবিধা হতে বঞ্চিত হবে। ফলে তাদের মধ্যে প্রবল অসন্তোষের সৃষ্টি হবে।
১১. স্বাধীনতা ও সাম্যের আদর্শ : প্রথমে প্রয়োজন দেশের স্বাধীনতা। আর স্বাধীনতা অর্জনকারী শক্তিই হলো দেশের সর্বসাধারণ। শুধু স্বাধীনতা অর্জন নয় একে রক্ষার দায়িত্বও জনসাধারণের। এজন্য প্রয়োজন সাধারণের মধ্যে সাম্যের আদর্শ উদ্বুদ্ধ করা। সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রদানেই কেবল জনসাধারণের মধ্যে সাম্যের আদর্শ স্থাপিত হতে পারে।
১৩. কর্তব্যবোধ জাগ্রত হয় : সর্বজনীন ভোটাধিকার নাগরিকদের সমাজ সচেতন করে তোলে। ভোটাধিকারের গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত হওয়ার ফলে সামাজিক দায়িত্ব পালন, সুষ্ঠুভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ, দুর্নীতি প্রতিরোধ, রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্য সম্পর্কে একটা অনুভূতি প্রবণতা ও নৈতিকতা গড়ে উঠে।
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি, নির্বাচন ব্যবস্থায় সর্বজনীন ভোটাধিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নির্বাচনকে সঠিক, নিরপেক্ষ ও সময় উপযোগী করার জন্য সার্বজনীন ভোটাধিকার খুব দরকার। সর্বজনীন ভোটাধিকার বিদ্যমান থাকলে যোগ্য নেতৃত্ব বাছাই করার সুযোগ থাকে। তাই গণতন্ত্রায়নে সর্বজনীন ভোটাধিকারকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়।