রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ও মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা কর।

রকেট সাজেশন
রকেট সাজেশন


অথবা, রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ও মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের তুলনামূলক আলোচনা কর।
অথবা, রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ও সংসদীয় সরকারের বৈসাদৃশ্যসমূহ আলোচনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা : রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার বলতে এমন একটি সরকারি ব্যবস্থাকে বুঝায় যেখানে শাসন বিভাগ। আইন বিভাগের প্রভাবমুক্ত থেকে স্বাধীনভাবে সংবিধান অনুসারে কার্য পরিচালনা করতে পারে। এ সরকারের শাসন বিভাগ আইন বিভাগের সমর্থনের উপর নির্ভরশীল থাকে না। আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগ স্বাধীনভাবে নিজ নিজ বিভাগের দায়িত্ব সম্পাদন করে। এ ব্যবস্থাধীনে রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতা একজন রাষ্ট্রপতি বা প্রেসিডেন্টের হাতে নাস্ত থাকে। রাষ্ট্রপতিই শাসন বিভাগের প্রকৃত প্রধান মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের ন্যায় এতে রাষ্ট্রপ্রধান নামেমাত্র শাসক নন, তিনি হলেন প্রকৃত শাসক প্রধান। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, আর্জেন্টিনা প্রভৃতি দেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার বিদ্যমান।

রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ও মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের পার্থক্য : নিম্নে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার ও রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের পার্থক্যসমূহ আলোচনা করা হলো-

১. মন্ত্রিসভার ক্ষেত্রে পার্থক্য: মন্ত্রিপরিষদ শাসিত শাসনব্যবস্থায় আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। মন্ত্রিসভার শীর্ষ নেতা হিসেবে একজন প্রধানমন্ত্রী থাকেন। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার পরামর্শ অনুসারেই দেশের নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধান দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রীরা রাষ্ট্রপতির নিকট দায়িত্বশীল থাকে।

২. সমনীয়তার ক্ষেত্রে: মন্ত্রিপরিষদ শাসিত শাসনব্যবস্থা সাধারণত নমনীয় হয় এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে সংগতি সাধন করতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থা সাধারণত অনমনীয় হয় এবং সহজে পরিবর্তিত অবস্থার সাথে সামজস্য রক্ষা করতে পারে না।

৩. আইনসভার প্রাধান্য: তত্ত্বগতভাবে মন্ত্রিপরিষদ শাসনব্যবস্থায় পার্লামেন্ট বা আইনসভার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠি কিন্তু রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

৪. স্থায়িত্বের ক্ষেত্রে : সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার স্থায়ী হয় না। দেশে বহুদলীয় ব্যবস্থা বর্তমান থাকলে ঘন ঘন সরকার পরিবর্তনের আশঙ্খা থাকে। তাই মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার নিরবচ্ছিন্নভাবে কোন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে না। কিন্তু রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার স্থায়ী হয়। তাই এ সরকার নিরবচ্ছিন্নভাবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবে কার্যকর করতে পারে।

৫. জরুরি অবস্থা : মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার জরুরি অবস্থার ক্ষেত্রে উপযোগী নয়। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তাই জরুরি অবস্থায় দ্রুত এবং দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় না। কিন্তু রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি দ্রুত এবং দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। তাই এ সরকার জরুরি অবস্থার উপযোগী।

৬. সংখ্যাগরিষ্ঠের ক্ষেত্রে: মন্ত্রিপরিষদ শাসনব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর দলের সদস্যরাই আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ। তা না হলে মন্ত্রিসভা ক্ষমতাসীন থাকতে পারে না। কিন্তু রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি যে রাজনৈতিক দলের সদস্য
দেশের আইনসভায় সে দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নাও থাকতে পারে।

৭. স্বৈরাচারিতার ক্ষেত্রে: মন্ত্রিপরিयন শাসিত শাসনব্যবস্থায় শাসন বিভাগের স্বৈরাচারী হওয়ার ভয় থাকে না। পক্ষান্তরে, রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় শাসন বিভাগ স্বৈরাচারী ও একনায়ক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

৮. ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগ : আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ পার্লামেন্টারীয়
শাসনব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এ শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রিসভার সদস্যগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল থেকে মনোনীত হন। কিন্তু আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির ব্যাপক প্রয়োগের ভিত্তিতেই রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের সৃষ্টি হয়। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির ভিত্তিতে সৃষ্টি হয় বলেই এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগ পরস্পর নিয়ন্ত্রণমুক্ত থাকে। শাসন বিভাগের প্রধান রাষ্ট্রপতি আইন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। আইন বিভাগও তেমনি রাষ্ট্রপতিকে প্রভাবিত করতে পারে না।

৯. পচ্যুত করার ক্ষেত্রে: মন্ত্রিসভার কার্যকাল আইনসভার সদস্যদের আস্থার উপর নির্ভরশীল। আইনসভার অধিকাংশের আস্থা হারালে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করতে হয়। কিন্তু রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তাকে পদত্যাগ করানো যায় না। কেননা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তিনি জনগণ কর্তৃক মনোনীত হন।

১০. কার্যক্রমের ক্ষেত্রে: মন্ত্রিপরিষদ শাসিত শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রিগণ আইনসভার কাজে অংশ নেন। তারা আইন প্রণয়নের কাজে নেতৃত্ব দেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি বা মন্ত্রিগণ আইনসভার কাজে অংশ নেন না। তারা আইন প্রণয়নের কাজে প্রভাব বিস্তার করতে পারেন না।

১১. প্রাধান্যের ক্ষেত্রে : মন্ত্রিপরিষদ শাসিত শাসনব্যবস্থায় সংবিধানের চেয়ে আইনসভার প্রাধান্য স্বীকৃত। অপরদিকে, রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় সংবিধানের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

১২. আইনসভার স্থায়িত্ব : মন্ত্রিপরিষদ শাসিত শাসনব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী আইনপরিষদ ভেঙে দেয়ার জন্য অনুষ্ঠান করলে রাষ্ট্রপ্রধান আইনপরিধন ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। অন্যদিকে, রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি আইনপরিষদ ভেঙে দিতে পারেন না।

১৩. মর্যাদাগত তুলনা : মন্ত্রিপরিষদ শাসিত শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীর সহকর্মী হিসেবে সমান মর্যাদা লাভ করেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রিগণ রাষ্ট্রপতির অধীনস্থ কর্মচারী মাত্র, সহকর্মী নন, রাষ্ট্রপতি তাদের যে কোন সময়ে পদত্যাগ করাতে পারেন।

১৮. সংবিধান : রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের সংবিধান সাধারণত দুষ্পরিবর্তনীয় হয়ে থাকে। এ শাসনব্যবস্থায় আইন বিভাগ বা শাসন বিভাগ কেউই এককভাবে সংবিধান পরিবর্তন করতে পারে না। কিন্তু মন্ত্রিপরিষদ সরকারে সংবিধান সাধারণত সুপরিবর্তনীয় হয়ে থাকে। সামান্যতম সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে আইনসভা সংবিধান সংশোধন বা পরিবর্তন করতে পারে।

উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি, উপরের আলোচনা থেকে সহজেই স্পট হয়ে উঠে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত
ও রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের মধ্যে কি পার্থক্য বিদ্যমান। এ দুই ধরনের সরকারের মধ্যে আকাশপাতাল ব্যবধান
সরকার নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য স্বতন্ত্র।