অথবা, বাংলাদেশে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির সম্পর্ক আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির যোগসূত্র স্থাপন কর ।
উত্তর : ভূমিকা : আধুনিক বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর রাজনৈতিক সংস্কৃতির অঙ্গনে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত বা
সংসদীয় শাসনব্যবস্থা এক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অধিষ্ঠিত আছে। কোন দেশের রাজনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণের জন্য রাজনৈতিক কৃষ্টি বা সংস্কৃতির প্রয়োজন অনস্বীকার্য। কেননা একটি দেশের রাজনৈতিক অবস্থা ও উন্নয়ন সে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। বাংলাদেশও তেমনি তার নিজস্ব রাজনৈতিক সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশে দু’ধরনের শাসনব্যবস্থা। যথা সংসদীয় শাসনব্যবস্থা ও রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থার মধ্যে সংসদীয় শাসনব্যবস্থাই জনপ্রিয় শাসনব্যবস্থা হিসেবে রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে গোড়াপত্তন করেছে। এছাড়া সংসদীয় শাসনব্যবস্থার কল্যাণকামী রাজনৈতিক সংস্কৃতি বাংলাদেশের মানুষের মৌলিক অধিকার, সাম্য ও স্বাধীনতার উপর সুপ্রতিষ্ঠিত।
সংসদীয় ব্যবস্থায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সামঞ্জস্যতা : ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করার পর বাংলাদেশে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত বা সংসদীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করা হয়। পরবর্তীতে এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংসদীয় ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হলেও ১৯৯১ সালে আবার দেশে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও ইতিহাস মূলত মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের ইতিহাস। বাংলাদেশে এ সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা রাজনৈতিক সংস্কৃতির সাথে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ সেটা নিম্নে আলোকপাত করা হলো :
১. ভৌগোলিক দিক দিয়ে অনুকূল : বাংলাদেশের জনগণের ভৌগোলিক অর্থগুতা ও ভাষা ঐতিহ্যগত ঐক্য পুরোমাত্রায় বিদ্যমান। জনগণের ভাষা, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, রীতিনীতি ও আচার আচরণ সম্পূর্ণ এক ও অভিন্ন। ব্রিটেনের সাথে এদিক থেকে বাংলাদেশের তুলনা করা যায়। ভৌগোলিক অখণ্ডতা যেমন ব্রিটেনকে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সাহায্য করেছে, তেমনি বাংলাদেশকেও আঞ্চলিক অখণ্ডতা অনুরূপ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহায়তা করবে।
২.নানাবিধ সমস্যার প্রেক্ষিতে উপযোগিতা : একটি উন্নয়নকামী রাষ্ট্রে সাধারণত যে সকল সমস্যা বিদ্যমান থাকে বাংলাদেশেও সেগুলো লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশের জাতীয় জীবনের সকল পর্যায়েই রয়েছে বহুবিধ সমস্যা, যথা সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীপতা, সঠিক পরিকল্পনা, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও জনগণের সাহায্য সহযোগিতা। আর এক্ষেত্রে সংসদীয় সরকারের ন্যায় দায়িত্বশীল সরকার এক আশীর্বাদস্বরূপ।
৩. রাজনৈতিক চেতনার উপযোগী : বাংলাদেশের মানুষ রাজনৈতিকভাবে যথেষ্ট সচেতন না হলেও এদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সচেতনতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেদিক দিয়ে বিচার করলেও এ রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সংসদীয় সরকার যথেষ্ট সামঞ্জস্যপূর্ণ। কেননা এদেশের জনগণের নিকট সংসদীয় সরকারের মত জবাবদিহিমূলক সরকারই বেশি কামা। বস্তুত বাংলাদেশে সংসদীয় সরকার বিশেষভাবে উপযোগী।
৪. ঐতিহ্যের সাথে সংগতিপূর্ণ : মন্ত্রিপরিষদ শাসিত বা সংসদীয় সরকার বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংগতিপূর্ণ। ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই এদেশে পর্যায়ক্রমে সংসদীয় সরকার প্রবর্তনের প্রয়াস নেয়া হয়। পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে সংসদীয় সরকার প্রবর্তন করা হলেও পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ক্রমশ স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেন। এ অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতেই পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্রীয় ব্যবস্থা চালু করা হয়। আর এ ব্যবস্থায় জনসাধারণের পূর্ণ সমর্থন ছিল। ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান পরিবর্তন করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার চালু করলেও প্রথমে শেখ মুজিব এবং পরে জিয়াউর রহমান এর হত্যার মধ্য দিয়ে এ সরকার ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটে যা এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য বিপজ্জনক হিসেবে প্রতিপন্ন হয়।
উপসংহার: উপযুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতির সাথে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা যথেষ্ট সামজস্যপূর্ণ। বাংলাদেশের জন্য মন্ত্রিপরিষদ শাসিত বা সংসদীয় সরকার ব্যবস্থাই বেশি উপযোগী। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় জনমতকে অগ্রাধিকার দেয়া হয় এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিচারবুদ্ধি প্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কার্যাবলি পরিচালিত হয়। তাই এ সরকারকে অন্যান্য সরকার ব্যবস্থার তুলনায় উত্তম বলা হয় যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।