অথবা,গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অসুবিধাসমূহ আলোচনা কর।
অথবা,গণতন্ত্রের নেতিবাচক দিকসমূহ আলোচনা কর।
উত্তর: ভূমিকা : আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ‘গণতন্ত্র’ একটি বহুল আলোচিত বিষয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অপর কোন বিষয়কে কেন্দ্র করে এত বেশি আলোচনার ঝড় বা এত বেশি বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় নি। গণতন্ত্র কোন নতুন ব্যবস্থা নয়। প্রাচীন কালে গ্রিস দেশে এ ধারণার সৃষ্টি হয়। সে সুদূর অতীত থেকে বিভিন্ন শতাব্দীতে নতুন নতুন ধ্যানধারণা একে প্রভাবিত করেছে। বর্তমান বিশ্বে এটি একটি জনপ্রিয় শাসনব্যবস্থা।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দোষ ও অসুবিধাসমূহ : বিভিন্ন গুণাবলির অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে সমালোচনার অভাব নেই। সমালোচকরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে গণতন্ত্রের সমালোচনা করেছেন। সমালোচনা বা ত্রুটি বা অসুবিধাসমূহ নিম্নরূপ :
১. পুঁজিবাদের ত্রুটি : গণতন্ত্রে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থাকায় অধিকাংশ সম্পদ মুষ্টিমোর পুঁজিপতিদের হাতে কেন্দ্রীভূত
হয়। ফলে দেশের প্রশাসনিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বিধান পুঁজিপতিদের করায়ত্ত হয়।
২. আমলাতন্ত্রের ত্রুটি : গণতন্ত্রে জন প্রতিনিধিদের সুষ্ঠু শাসনকার্যের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা থাকে না। ফলে প্রশাসনিক ব্যাপারে তারা আমলাদের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আর আমলাদের প্রাধান্য প্রতিপত্তির জন্য জনসাধারণের স্বার্থ অবহেলিত হয়।
৩. অম্ল ও অশিক্ষিতদের শাসন : গণতন্ত্র অশিক্ষিত, অম্ল ও অক্ষম ব্যক্তির শাসন। কারণ গণতন্ত্র হলো জনগণের শাসন এবং জনগণের অধিকাংশই অশিক্ষিত ও অম্ল। লেকি বলেছেন, গণতন্ত্র হলো সর্বাপেক্ষা দরিদ্র, সর্বাপেক্ষা এবং সর্বাপেক্ষা অযোগ্য ব্যক্তির শাসনব্যবস্থা।
৪. ব্যয়বহুল : অনেকের মতে, গণতন্ত্র হলো একটি ব্যয়বহুল শাসনব্যবস্থা। ঘন ঘন নির্বাচনের ব্যবস্থা, জনমত যাচাই, ব্যাপক প্রচারকার্য প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে সরকার প্রচুর অর্থের অপচয় করে।
৫. সংখ্যালঘুদের স্বার্থের অবহেলা : গণতন্ত্র হলো সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনব্যবস্থা। তাই সংখ্যালঘুরা আইনসভায় তাদের
প্রতিনিধি প্রেরণ করতে পারে না। ফলে তাদের স্বার্থ অবহেলিত হয়।
৬. সততা ও যোগ্যতার কদর নেই : যে কোন শাসনব্যবস্থার সাফল্য শাসকবর্গের বুদ্ধিমত্তা ও গুনগত যোগ্যতার উপর নির্ভরশীল। কিন্তু গণতন্ত্রে সততা ও যোগ্যতার যোগ্য মর্যাদা দেয়া হয় না। এখানে শিক্ষিত অশিক্ষিত, যোগ্য অযোগ্য নির্বিশেষে সকলকে সমান গুরুত্ব দেয়া হয়।
৭. রক্ষণশীল: গণতন্ত্র অশিক্ষিত ও অম্ল ব্যক্তির শাসন। তাই এ শাসনব্যবস্থা প্রকৃতিগত শাসন। এ শাসনব্যবস্থা প্রকৃতিগতভাবে প্রগতি বিরোধী ও রক্ষণশীল। F. W. Coker न করেছেন- Democracity are the most conservative of all forms of state,
৮. দল প্রথার কুফল: গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব অপরিহার্য। গণতন্ত্রে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। সে দলই সরকার গঠন করে। ফলে কার্যত দলীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। সরকারি দল প্রায় ক্ষেত্রেই বৃহত্তম জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে সংকীর্ণ দলীয় সার্থকেই প্রাধান্য দেয়।
৯.ক্ষণস্থায়ী ও ভঙ্গুর: গণতন্ত্রে বহু পরস্পরবিরোধী মত ও ধারণা দেখা যায়। এতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মতপার্থক্য সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে কোন স্থায়ী সরকার গঠন করা যায় না। হেনরি মেইনের মতে, স্থায়ি অতার গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান এটি।
১০. জরুরি অবস্থার অনুপযোগী: বহিরাক্রমণ, অভ্যন্তরীণ গোলযোগ, প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রভৃতি সংকটময় মুহূর্তে দেশের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু গণতন্ত্রে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সরকার পরিচালিত হয় বিধায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিপদ হয়।
১১. নৈতিকতার অবনতি : গণতন্ত্র হলো সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণই হলো অম্ল ও অশিক্ষিত। এ অবস্থার চর ও স্বার্থপর কিছু নেতা মিথ্যাভাবের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে ক্ষমতাসীন হয়। নৈতিকতার অবনতি ঘটে।
১২. সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচার: সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে গণতান্ত্রিক সরকার নির্বাচিত হয়। এ ধরনের সরকার অনেক সময় স্বৈরাচারী হতে পারে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গেটেল (Gettell) মন্তব্য করেন যে, “গণতান্ত্রিক সরকারের পিছনে ব্যাপক ক্ষমতা থাকায় সর্বাপেক্ষা বিপজ্জনক সরকারে পরিণত হতে পারে।
১৩. দলীয় স্বার্থরক্ষা: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থাকে, যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে সে নাই সরকার গঠন করে। তাদের কঠোর দলীয় নিয়ন্ত্রণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অনুগত করে তোলে। ফলে তারা নিম্ন দলের স্বার্থরক্ষা করা সবচেয়ে বড় দায়িত্ব বলে মনে করে।
১৪. পুঁজিপতির শাসন : গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সাধারণত ধনী সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্য হতেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নির্বাচিত হয়ে থাকে। এর ফলে দেশে পুঁজিবাদী শাসক প্রতিষ্ঠিত হয়। পুঁজিপতিরা নিজের অবস্থার কথা
চিন্তা করেই আইন প্রণয়ন করেন, যা নিরীহ জনগণের তেমন উপকারে আসে না।
১৫. ভাবাবেশের প্রাধান্য গণতন্ত্রে যুক্তির পরিবর্তে ভাবাবেগকে প্রাধান্য দেয়া হয়। জনগণ ভাবাবেগ তাড়িত হয়ে অসৎ অযোগ্য ব্যক্তিবর্গের শাসন কায়েম করে।
উপসংহার: উপযুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, গণতন্ত্রের কিছু ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও গণতন্ত্র হলো বিশ্বনন্দিত শাসনব্যবস্থা। জনকল্যাণ সাধন ও স্বাধীন মতামত প্রকাশের জন্য গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বিশেষ উপযোগী। তবে গণতন্ত্রকে একেবারে ত্রুটিমুক্ত বলা যায় না। কিছু কিছু ত্রুটি রয়েছে যা সংশোধনযোগ্য এবং এগুলো দূর করা সম্ভব। Lipson মন্তব্য করেছেন, “Of all forms of Government known and tried, democracy is the wisest and the best.” পরিশেষে C. D. Burns এর মন্তব্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, “No one denies that existing representative assemblies are defective; but even if an automobile does not work well, it is foolish to go back to farm cart however romantic.”