অথবা, বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়ন পদ্ধতিটি উল্লেখ কর।
অথবা, বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রতিষ্ঠার প্রত্রিয়াটি উল্লেখ কর।
উত্তরঃ ভূমিকা : “The way of life the state has chosen for itself Aristotle.
সংবিধান হলো রাষ্ট্রে পরিচালনার মূল চালিকাশক্তি। সংবিধান যে কোন সরকার ব্যবস্থার একটি পবিত্র সংবিধান ব্যতীত কোন রাষ্ট্রই চলতে পারে না। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্ব মানচিত্রে ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ জারি করেন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলে একটি সংবিধানের প্রয়োজন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। আর স্বাধীনতার মাত্র দশ মাসের মধ্যেই ১৯৭২ সালে রচিত হয় বাংলাদেশের সংবিধান। অবশ্য পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংশোধন সাধিত হয়েছে। ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ার বিবরণ নিম্নে তুলে
বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের ইতিহাস : ১৯৭১ সালে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের আবির্ভাব হওয়ার পর সংগত কারণেই একটি সংবিধানের প্রয়োজনীয়তা সর্বপ্রথম অনুভূত হয়। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাস হতেই বাংলাদেশের সংবিধান তৈরির কাজ শুরু করা হয়। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহ দেশে ফিরে এসে ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির এক আদেশের মাধ্যমে বাংলাদেশে অস্থায়ী সাংবিধানিক অধ্যাদেশ জারি করেন
১. গণপরিষদ আদেশ ১৯৭২ সালের ২০ মার্চ রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ জারি করেন।অনুযায়ী ১৯৭০ সালের এবং ১৯৭১ সালের নির্বাচন অনুযায়ী জাতীয় পরিষদের ১৬৯ জন এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত ৩০০ জন সর্বমোট ৪৬৯ জন সদস্য নিয়ে গণপরিষদ গঠিত হয়। যাদের উপর দায়িত্ব ছিল একটি পূর্ণাঙ্গ সংবিধান প্রণয়নের
২. গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন : রাষ্ট্রপতি ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন আহ্বান করেন।অধিবেশনের প্রথম দিনে গণপরিষদ সদস্যগণ কর্তৃক স্পিকার নির্বাচিত হন শাহ আব্দুল হামিদ ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হলো জনাব মোহাম্মদ উল্লাহ। ১১ এপ্রিল ড. কামাল হোসেনকে সভাপতি করে ৩৪ সদস্যবিশিষ্ট খসড়া সংবিধান প্রদান কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৭২ সালের ১০ জুন উক্ত কমিটি এক বৈঠকে সংবিধানের একটি প্রাথমিক খসড়া অনুমোদন করেন
৩. গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর বাংলাদেশ গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন বসে। সেদিনই আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক কমিটি কর্তৃক উত্থাপিত সংশোধনীর সাথে সংগতি রক্ষা করে খসড়া সংবিধান কমিটির সভাপতি ড. কামাল হোসেন সংবিধানটিকে বিল আকারে গণপরিষদে পেশ করেন।
৪. উদ্বোধনী অনুষ্ঠান : রাষ্ট্রপতি ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আহ্বান করেন। অধিবেশনে শাহ আব্দুল হামিদ ও মোহাম্মদ উল্লাহ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যথাক্রমে গণপরিষদের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন। এ অধিবেশনে ৪১৪ রান সদস্য উপস্থিত ছিলেন
৫. অস্থায়ী সংবিধান আদেশ অস্থায়ী সাংবিধানিক আদেশে বলা হয় যে, ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর ও ১৯৭১ সালের
জানুয়ারি মাসে নির্বাচিত সকল জাতীয় পরিষদ সদস্য ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য সম্মিলি বাংলাদেশের প্রথম গণপরিষদের সদস্য বলে বিবেচিত হবেন। এ আদেশের মাধ্যমে বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের পরিবর্তে সংসদীয় সরকারের প্রবর্তন করা হয় এবং সমগ্র বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য হবে বলে ঘোষণা করা হয়। গণপরিষদের সদস্যদের উপরই সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের সংবিধান রচনার ভার অর্পণ করা হয়।
৬. সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন : ১৯৭২ সালের ১২ এপ্রিল গণপরিষদ খসড়া সংবিধান প্রণয়নের জন্য ৩ সদস্যবিশিষ্ট এক কমিটি গঠন করে। এ সময় বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন এ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। এ কমিটিতে একজন বাদে সকল সদস্যই আওয়ামী লীগের দলীয় সদস্য ছিলেন গণপরিষদে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (মোজাফফর) সদস্য শ্রী সুরঞ্জিত সেন গুপ্তই কেবল আওয়ামী লীগের বাহির হতে উক্ত কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হন। গণপরিষদের ৭ জন মহিলা সদস্যের মধ্যে একজনকে এ কমিটির সদস্য করা হয়। এ কমিটিকে ১৯৭২ সালের ১০ জুনের মধ্যে একটি বিলের আকারে তাদের রিপোর্ট গণপরিষদে পেশ করতে বলা হয়।
৭. গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন : গণপরিষদ গঠিত হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল পরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে। দুই দিনব্যাপী এ অধিবেশনের প্রথম দিনে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন করা হয়। দ্বিতীয় দিনে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ৩৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি নির্বাচন করা হয়। ১৯৭২ সালের ১০ জুনের মধ্যে কমিটিকে রিপোর্ট করতে বলা হয়। খসড়া সংবিধান কমিটি সর্বমোট ৭৪টি বৈঠকে মিলিত হয়। কমিটির প্রথম বৈঠকের প্রস্তাব অনুযায়ী বিভিন্ন সংগঠনের কাছ থেকে খসড়া সংবিধান সম্পর্কে প্রস্তাব চাওয়া হয় ।
১৯৭২ সালের ১০ জুনের বৈঠকে সংবিধানের একটি প্রাথমিক খসড়া অনুমোদিত হয়। যেহেতু বাংলাদেশ সংবিধানে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে বলে স্থির করা হয়েছিল, সেহেতু একে পূর্ণাঙ্গ ও যথাসম্ভব ফলপ্রসূ করে তোলার লক্ষ্যে কমিটির সভাপতি ড. কামাল হোসেন ভারত ও ব্রিটেন সফর করেন। তিনি উভয় দেশের পার্লামেন্টের কার্যকারিতা প্রত্যক্ষ করেন এবং দেশে ফিরে উক্ত অভিজ্ঞতা কাজে লাগান। কমিটির সভাপতি ১১ জুন প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করেন এবং খসড়া সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ে আলোচনা করেন। ১১ অক্টোবর কমিটি সর্বশেষ আলোচনা করেন এবং ঐ দিন সংবিধানের পূর্ণাঙ্গ খসড়া চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়।
৮. গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন : বাংলাদেশ গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন বসে ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর এবং ১৩ অক্টোবর গণপরিষন কতিপয় সংশোধনী মতে খসড়া সংবিধান কার্যপ্রণালি সংক্রান্ত বিধিমালা গ্রহণ করেন। গণপরিষদে সাংবিধানিক বিলটির উপর বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, “এ সংবিধান শহীদের রক্তে লিখিত।” সে সাথে তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, এ সংবিধান দেশের সমগ্র জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক বলে বিবেচিত হবে। সংবিধান বিলটি উত্থাপনকালে আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন বলেছিলেন, “এ সংবিধান গণতান্ত্রিক উপায়ে এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করে এমন এক সমাজব্যবস্থা, যাতে আইনের শাসন, মৌল মানবিক অধিকার এবং স্বাধীনতা, সাম্য ও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার সকল নাগরিকের জন্য অর্জিত হবে।”
৯.প্রাথমিক খসড়া অনুমোদন : ১৯৭২ সালের ১০ জুন খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির এক বৈঠকে সংবিধানের একটি প্রাথমিক খসড়া অনুমোদিত হয়। বাংলাদেশ সংবিধানের খসড়াকে নিখুঁত ও ত্রুটিমুক্ত করে নেয়ার জন্য কমিটি একজন ব্রিটিশ খসড়া বিশেষজ্ঞের সাহায্য ও পরামর্শ গ্রহণ করে। এ খসড়া সংবিধানের বাংলা অনুবাদ সম্পন্ন করার জন্য কয়েকজন ভাষাবিদেরও সাহায্য নেয়া হয়।
১০. সংবিধান বিধিবন্ধকরণ : ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর গণপরিষদ অধিবেশনে মিলিত হয়। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্যদের নিকট হতে গৃহীত প্রায় ৭৫০টি সংশোধনী প্রস্তাব পরীক্ষা করে মাত্র কয়েকটি গ্রহণ করা হয়। ১৯অক্টোবর থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত সংবিধান বিল সম্পর্কে সাধারণ আলোচনা চলে। অতঃপর ৩১ অক্টোবর খসড়া সংবিধানের দফাওয়ারী আলোচনা শুরু হয়। ৩ নভেম্বর কতকগুলো সংশোধনীসহ খসড়া সংবিধানের সকল অনুচ্ছেদ ও তফসিল গৃহীত হয়। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে জনপ্রতিনিধিগণ স্বাধীন বাংলাদেশের স্থায়ী সংবিধান বিধিবদ্ধ করেন। এভাবে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর হতে বিধিবদ্ধ সংবিধান বলবৎ হয়।
খসড়া প্রস্তাব চূড়ান্তভাবে গ্রহণ : ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর বাংলাদেশের জীবনে একটি গৌরবোজ্জ্বল দিন। ঐ দিন বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটের সময় ৭৩ পৃষ্ঠাবিশিষ্ট খসড়া সংবিধান অধিবেশনে পেশ করেন আইন মন্ত্রী ড. কমাল হোসেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান অতীতের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন, “বাংলাদেশ গণপরিষদ যে সংবিধান রচনা করেছে, তা বাংলাদেশের জনগণের ভাষা রকে দেখা হয়েছে। আইনমন্ত্রী বলেছেন, “স্বপ্ন আ নামিত হয়েছে। এ সংবিধান বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক টি নিদর্শন। ১৯৭২ সালের ৪ বাংলাদেশের সংবিধানকে লিপিবদ্ধ করেন। সেদিন বেলা ১টা ৩০ মিনিট ৪০ সেকেন্ড এর সময় গণপরিষদের সদস্যদের তুমুল করতালি ও হাপানির মধ্য দিয়ে সংবিধানটি পাস হয় এবং তা চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়।এ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, “একটি জাতি হিসেবে বাঙালি ইতিহাসে প্রথমবারের মতো তাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে সংবিধান প্রণয়ন করলো।” অতঃপর ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর ‘Victory Day’ বা ‘বিজয় দিবস’ হতে এটি কার্যকরী হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশ শুধুমাত্র নয় মাস সময়ের মধ্যেই সংবিধান তৈরির সফলতা অর্জন করতে পেরেছিল এবং এটি ছিল বাংলাদেশিনের জন্য অত্যন্ত আনন্দ ও গর্বের বিষয়। সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে সাধারণত কোন দেশ যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেসব সমস্যা দেখা দেয় নি। এখানে আঞ্চলিকতা ও সাম্প্রদায়িকতার কোন প্রভাব নেই। বাংলাদেশের সংবিধান বলবৎ ও কার্যকরী হয়েছে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে। সংবিধানের যথার্থ প্রয়োগ বাংলাদেশকে উন্নয়নের পথ দেখাবে।