অথবা, সুপরিবর্তনীয় ও দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানের মধ্যে যে বৈসাদৃশ্য রয়েছে তা দেখাও ।
অথবা, সুপরিবর্তনীয় ও দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানের মধ্যে তুলনামূলক পার্থক্য উল্লেখ কর। উত্তরঃ ভূমিকা : “Constitution is that body of rules which regulates the ends for which and
of the organs through which the powers of the government is exercised.” [K. C. Wheare, The Statute of Westminister, P-12] সংবিধান হলো রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক নীতি এবং একটি দেশের মেরুদণ্ডস্বরূপ। সংবিধান ভিন্ন কোন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। সংবিধান হলো রাষ্ট্র পরিচালনার দিকনির্দেশনা। সংবিধানের মাধ্যমেই রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। সংবিধান ছাড়া কোন রাষ্ট্রই সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে পারে না। সংবিধান হচ্ছে যে কোন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন, যা অন্যান্য আইন এবং সরকারকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে। প্রতিটি স্বাধীন দেশের জন্য সংবিধান অত্যাবশ্যক। আর উত্তম সংবিধানের মাধ্যমেই জনগণের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটে এবং শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক নির্ণীত হয়।
সুপরিবর্তনীয় ও দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানের মধ্যে পার্থক্য : সুপরিবর্তনীয় ও দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানেরমধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করার পূর্বে সুপরিবর্তনীয় ও দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান বলতে কি বুঝায় তা জেনে নেয়া আবশ্যক। সুপরিবর্তনীয় সংবিধান (Flexible constitution) : “If a constitution may be easily amended by the ordinary law making body and procedure if maybe classed flexible”.
সুপরিবর্তনীয় সংবিধান বলতে সহজে পরিবর্তনশীল সংবিধানকে বুঝায়। অন্যভাবে বলা যায়, সাধারণ আইন প্রণয়ন পদ্ধতির মাধ্যমে যে সংবিধানকে সংশোধন করা যায়, তাকে সুপরিবর্তনীয় বা নমনীয় সংবিধান বলে। সাধারণভাবে
আইনসভায় উপস্থিত সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটদানকারীর সমর্থনে এ সংবিধান সংশোধন করা যায়। ইংল্যান্ডের অলিখিত সংবিধান এবং নিউজিল্যান্ডের লিখিত সংবিধান সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের উদাহরণ।
বর্তনীয় সংবিধান (Rigid constitution) : যে সংবিধান সংশোধন, পরিবর্তন বা পরিবর্ধনের জন্য দেশের
প্রচলিত সাধারণ আইন পাসের পদ্ধতি ব্যতিরেকে ভিন্নতর কোন বিশেষ বা জটিল পদ্ধতি অবলম্বনের প্রয়োজন হয়, তাকে দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান বলে। যেমন- আমেরিকার সংবিধান দুষ্পরিবর্তনীয়।সুপরিবর্তনীয় ও দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানের সংজ্ঞা ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে উভয়ের ভিতর কতকগুলো পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে উঠে। নিম্নে পার্থক্যগুলো আলোচনা করা হলো :
১. সংশোধনী পদ্ধতির দিক থেকে : সুপরিবর্তনীয় সংবিধান সহজেই পরিবর্তনযোগ্য। আইনসভায় সাধারণ আইন যেভাবে প্রণীত হয়, সেভাবেই এ সংবিধানকে সংশোধন করা সম্ভব। সংশোধনের জন্য বিশেষ কোন জটিল পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয় না।কিন্তু দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান সহজে পরিবর্তন করা যায় না। এ ধরনের সংবিধানকে সংশোধন করতে হলে এক বিশেষ জটিল পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়।
২.লিখিত ও অলিখিত : সুপরিবর্তনীয় সংবিধান লিখিত ও অলিখিত দু’রকমের হতে পারে। কিন্তু দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান লিখিত হতে বাধ্য। যেমন- আমেরিকার সংবিধান।
৩. সাংবিধানিক ও সাধারণ আইনের পার্থক্য:সুপরিবর্তনীয় শাসনতন্ত্রে এ দু’টি আইনের মধ্যে কোনপ্রকার পার্থক্য করা হয় না। কিন্তু দুষ্পরিবর্তনীয়তার ক্ষেত্রে সাধারণ আইন ও সাংবিধানিক আইনের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করা হয়। দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানে সাধারণ আইনের চেয়ে সাংবিধানিক আইনের অধিক মর্যাদা স্বীকৃত হয়।
৪. সার্বভৌম ক্ষমতার দিক থেকে : শাসনতন্ত্র সুপরিবর্তনীয় হলে রাষ্ট্রের সার্বভৌম কর্তৃত্ব আইনসভার হাতে আসে।
অর্থাৎ সুপরিবর্তনীয় সংবিধানে সাধারণত আইনসভা সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান নিজেই
সর্বোচ্চ কর্তৃত্বের অধিকারী হয়ে থাকে। কারণ এক্ষেত্রে আইনসভাকে শাসনতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকতে হয়।
৫. স্থায়িত্বের দিক থেকে : সুপরিবর্তনীয় সংবিধান অনির্দিষ্ট ও গতিশীল হয়ে থাকে। অন্যদিকে, দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান নির্দিষ্ট ও স্থিতিশীল হয়ে থাকে।
৬. উৎসের দিক থেকে : সুপরিবর্তনীয় সংবিধানে সাংবিধানিক আইন ও সাধারণ আইনের উৎস এক ও অভিন্ন। কিন্তু দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানে উভয় আইনের উৎস সাধারণত ভিন্ন হয়ে থাকে ।
৭. গণতন্ত্র সংরক্ষণের দৃষ্টিকোণ থেকে : সুপরিবর্তনীয় সংবিধান গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে হুমকিস্বরূপ। শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দল অথবা শ্রেণি নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী আইন ও সংবিধান সংশোধন করে গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করতে পারে। অন্যদিকে, দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান অধিকার অনেক বেশি সংরক্ষিত। এ সংবিধানের সংশোধন পদ্ধতি “অত্যন্ত জটিল। ইচ্ছা করলেই যখন তখন এ সংবিধান সংশোধন করা যায় না। তাই দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানে গণতন্ত্র তুলনামূলকভাবে বেশি সংরক্ষিত হয়।
৮. মৌলিক অধিকার রক্ষার পার্থক্য : সুপরির্তনীয় সংবিধানে মৌলিক অধিকার লিখিত অবস্থায় থাকে না। তাই অধিকার প্রতিষ্ঠিত করাও যায় না। কিন্তু দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানে মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ থাকে। লিখিত সংবিধান পাঠ করে জনসাধারণ তাদের মৌলিক অধিকার ভোগ এবং তার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে অবগত হতে পারে।
৯. বিক্ষোভ ও বিদ্রোহের আশঙ্কা : বলা হয় যে, সুপরিবর্তনীয় সংবিধান নমনীয় চরিত্রেরা কারণে জনগণের আশা- আকাঙ্ক্ষার সাথে সহজে সমন্বিত হতে পারে। ফলে গণবিক্ষোভ ও বিদ্রোহের সম্ভাবনা কম থাকে। পক্ষান্তরে, দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানে গণবিক্ষোভ, বিদ্রোহ এবং অসন্তোষের সম্ভাবনা বেশি থাকে। এ সংবিধান সহজে সংশোধন করে নতুন পরিস্থিতির সাথে সংগতি রক্ষা করা যায় না।
১০. বিচার বিভাগের রায়ের ক্ষেত্রে: সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের ক্ষেত্রে আইনসভার প্রধান্য স্বীকৃত হয়। যেমন হয়েছে। ব্রিটেনে। ব্রিটেনে পার্লামেন্টের আইনকে বিচার বিভাগ নাকচ করাতে পারে না। কিন্তু দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানে বিচার বিকাশেও প্রাধান্য বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। আইনসভা যদি সংবিধান বহির্ভূত কোন আইন প্রণয়ন করে, তাহলে চার বিভাগ তার বৈধতা যাচাই করেত পারে। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে এ বিধান দেখা যায়।
১১. যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় উপযোগিতার ক্ষেত্রে: যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় সুপরিবর্তনীয় সংবিধান অনুপযোগী বিবেচিত হয়। পক্ষান্তরে, দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান অনমনীয় বিধায় সহজেই কেন্দ্র ও প্রদেশগুলোর শাসনব্যবস্থার মধ্যে সহজে পরিবর্তন সাধন করে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয় না। ফলে এরূপ সংবিধান যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার উপযোগী বলে গণ্য করা হয়।
১২. জনমতের প্রতিফলনের দিক দিয়ে: সুপরিবর্তনীয় সংবিধান অলিখিত থাকে, তাই এ সংবিধানে জনমতের প্রতিফলন ঘটে না। পক্ষান্তরে, দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান লিখিত থাকে, তাই এ সংবিধানে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে। কারণ জনগণ তাদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে অবগত হতে পারে।
উপসংহার উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, সুপরিবর্তনীয় ও দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানের মধ্যে যে পার্থক্য নির্দেশ করা হয়েছে তা অনেকটা অবৈজ্ঞানিক, অযৌক্তিক ও অবাস্তব। উভয়ের মধ্যে পার্থক্যের সুস্পষ্ট সীমারেখা টানা সম্ভব নয়। কারণ তত্ত্বগতভাবে সত্য হলেও বাস্তবে কোন সংবিধানই সম্পূর্ণরূপে দুষ্পরিবর্তনীয় বা সম্পূর্ণরূপে সুপরিবর্তনীয় নয়।রাষ্ট্রবিজ্ঞানী Lawrence এর মতে, “সুপরিবর্তনীয় ও দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানের শ্রেণিবিভাগ কদাচিৎ বাস্তব।”।