অথবা, কীভাবে সংবিধান প্রণয়ন করা হয় আলোচনা কর ।
অথবা, সংবিধান প্রতিষ্ঠার পদ্ধতিসমূহ আলোচনা কর ।
উত্তর: ভূমিকা : সংবিধান হলো বিশ্বের সকল স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশেষভাবে অপরিহার্য একটি দলিল। এটা রাজনৈতিক ব্যবস্থার মূলভিত্তি। সংবিধানবিহীন রাষ্ট্র কর্ণধারবিহীন জাহাজের সাথে তুলনীয়। কারণ সংবিধানের ভিত্তিতেই একটি রাষ্ট্র পরিচালিত হয়, সরকার গঠিত হয়, সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা বষ্টিত হয়, সরকারি কাজকর্ম পরিচালিত হয় এবং ব্যক্তি ও সরকারের মধ্যে সম্পর্ক নিরূপিত হয়। তাই প্রখ্যাত গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল বলেন, “Constitution is the way of life, the state has chosen for itself
সংবিধান প্রণয়নের পদ্ধতিসমূহ : বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে বিভিন্ন রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র বা সংবিধান প্রণীত হয়ে থাকে। অধ্যাপক গেটেল শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চারটি পদ্ধতির উল্লেখ করেছেন। নিম্নে এ চারটি পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
১. অনুমোদন:অনুসমর্থনের মাধ্যমে সংবিধান প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। রাষ্ট্র গঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে অধিকাংশ রাজ্যে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। শাসন ক্ষমতা কেবলমাত্র একজন স্বেচ্ছাচারী রাজার হাতেই নিশ্চিন্ত ছিল। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও গণতান্ত্রিক আদর্শ তখনো গড়ে ওঠেনি। সময়ের সাথে সাথে পরিস্থিতির পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের মনে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ গড়ে ওঠে এবং তাদের মধ্যে মৌলিক অধিকারের ধারণা জন্ম নেয়। এমতাবস্থায় জনমতের চাপে বা বিপ্লবের ভয়ে রাজা বা শাসকগোষ্ঠী একটি বিধিবদ্ধ দলের মাধ্যমে জনগণের কাছে শাসন ক্ষমতা প্রয়োগের অঙ্গীকার করে। রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত চুক্তির এই শর্তগুলি সংবিধান হিসাবে বিবেচিত হয়। এ ধরনের চুক্তির ফলে রাজার ক্ষমতার পরিধি অনেকটাই সীমিত হয়ে পড়ে। এভাবে ফরাসী সম্রাট নেপোলিয়ন, রুশ জার নিকোলাস, অস্ট্রিয়ার রাজা ফ্রান্সিস জোসেফ এবং জাপানের সম্রাট নিজ নিজ দেশের সংবিধান ঘোষণা করেন। এবং এটি অনুমোদন
২.গণপরিষদ: সংবিধান প্রণয়নের প্রকৃত পদ্ধতি। গণপরিষদের ইচ্ছাকৃতভাবে গঠনের মাধ্যমেও সংবিধান প্রতিষ্ঠিত হয়। আধুনিক রাষ্ট্রীয় সংবিধান প্রণয়নে পদ্ধতিটি বিশেষভাবে প্রচলিত। সংবিধান প্রণয়নের জন্য দেশে সাধারণত একটি গণপরিষদ গঠিত হয়। গণপরিষদের সদস্যরা সংবিধান প্রণয়ন করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে এটি অনুমোদিত হলে সংবিধান চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। কখনও কখনও গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত সংবিধান অনুসমর্থনের জন্য গণভোটে পাঠানো হয়। যেমন বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান। কে.সি. “আধুনিক সময়ে সংবিধান তৈরির এটাই স্বাভাবিক পদ্ধতি,” হুপার বলেছেন।
৩.ক্রমবিবর্তন: ঐতিহাসিক বিবর্তনের মাধ্যমে একটি রাষ্ট্রের সংবিধানও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। গণতান্ত্রিক মতাদর্শের প্রসারের ফলে, স্বৈরাচারীদের কাছ থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ক্রমবর্ধমানভাবে হস্তান্তরিত হতে পারে। এবং জনগণ শেষ পর্যন্ত তাদের প্রতিনিধিদের কর্তৃত্বকে বৈধ বলে স্বীকৃতি দিতে পারে। এভাবেই প্রচলিত রাজনৈতিক রীতিনীতির সঙ্গে সংবিধান বিকশিত হয়েছে। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ ব্রিটিশ সংবিধান।
৪. বিপ্লব : বিপ্লবের মাধ্যমেও অনেক সময় নংবিধান প্রতিষ্ঠিত হয়। বিপ্লব তখনই ঘটে যখন প্রচলিত সরকার ও সরকারের অত্যাচার উৎপীড়নে জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে যখন এ ধরনের সরকারের উৎখাত সবে হয় না, তখনই জনগণ বিপ্লবের পথ ধরে সরকারকে পরাভূত করে। বিপ্লব উত্তরকালে বিপ্লবী পরিষদই নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে। আবার কখনো সংবিধান কমিশনের উপর শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দায়িত্ব অর্পণ করে। এসব ক্ষেত্রে জনগণের অনুমোদনের জন্য গণভোটেরও ব্যবস্থা করা হয়। রাশিয়াতে এবং স্পেনে উক্ত পদ্ধতিতে সংবিধান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।উক্ত পদ্ধতিগুলো ছাড়াও প্রতিনিধি পরিষদের মাধ্যমেও সংবিধান প্রণীত হয়ে থাকে। তবে এ পদ্ধতির মাধ্যমে প্রণীত সংবিধান বর্তমান পৃথিবীতে খুবই বিরল। সাবেক পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান এ পদ্ধতিতে রচিত হয়েছিল। অবশ্য পরবর্তীতে এ সংবিধানের পরিবর্তে নতুন এক সংবিধান প্রণীত হয়। এক্ষেত্রে পূর্বের পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় নি।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ উপরোল্লিখিত পদ্ধতিগুলোর যে কোন একটি অবলম্বনকরে সংবিধান রচনা করেছে। তবে একথা সত্য যে, উপর্যুক্ত পদ্ধতিগুলোর মধ্যে গণপরিষদ কর্তৃক প্রণীত সংবিধানই শ্রেষ্ঠ
সংবিধান বলে স্বীকার করা হয়। আইনসভার সদস্যরা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে। সুতরাং জনগণের প্রতিনিধি দ্বারা প্রণীত সংবিধানেই জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে। এ ব্যাঙ্কারে K. C. Wheare এর কথা স্মরণযোগ্য, “জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত গণপরিষদ সংবিধান তৈরি করবে এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। অন্যান্য নিয়মগুলো বাতিক্রম মাত্র।