কর্মচারী নির্বাচন ও সংস্থাপন কী? কর্মচারী নির্বাচনের ক্ষেত্রে মনোবৈজ্ঞানিক অভীক্ষার বিবরণ দাও ।

রকেট সাজেশন
রকেট সাজেশন

ভূমিকা:কর্মচারী নির্বাচন ও সংস্থাপন এটি একটি গোপন এবং মনোবৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া যা কোনও সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানে নতুন কর্মচারী নিযুক্ত করার জন্য অনুষ্ঠিত হয়। এটি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় কর্মচারীদের নির্বাচনের প্রক্রিয়া থাকে, যাতে সেই পদে যারা যোগ দিতে যোগ্য তাদের নিযুক্ত হতে পারে।
মনোবৈজ্ঞানিক অভীক্ষার এই নির্বাচনে নির্বাচনী কর্মচারীদের মানসিক ও আচারব্যবহারিক দিকগুলি নিরীক্ষণ করে যায়। মনোবৈজ্ঞানিক অভীক্ষার প্রক্রিয়াটি নিম্নলিখিত ধাপে পরিচালিত হতে পারে:

নির্বাচনী পরীক্ষা: আবেগ, মানসিক দক্ষতা, পেশাদার দক্ষতা এবং আরও অন্যান্য মনোবৈজ্ঞানিক পরীক্ষা দ্বারা প্রারম্ভ হতে পারে।

মানসিক প্রস্থান: উম্মুক্তকরণ, চিন্তা, প্রস্তুতি করার জন্য উপযুক্তভাবে মানসিক প্রস্থানের অভ্যন্তরীণ দিক নিরীক্ষণ করা হতে পারে।

ইন্টারভিউ এবং ব্যক্তিগত পরিচর্যা: উম্মুক্তকরণ পরীক্ষা, ইন্টারভিউ, এবং ব্যক্তিগত পরিচর্যা সাধারণভাবে এই প্রস্তুতি দক্ষতা এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে নিরীক্ষণে ব্যবহার করা হতে পারে।

পেশাদার দক্ষতা: নির্বাচনী কর্মচারীদের কাজের পেশাদার দক্ষতা এবং স্থিতিশীলতা নিরীক্ষণ করা হতে পারে।
এই মনোবৈজ্ঞানিক অভীক্ষারের মাধ্যমে সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান তাদের পদের জন্য সঠিক এবং যোগ্য কর্মচারীগণকে নির্বাচন করতে সাহায্য করে এবং কর্মচারীর পেশাদার দক্ষতা এবং প্রফেশনালিজম বাড়াতে সাহায্য করে।

প্রামাণ্য সংজ্ঞা : উইলিয়াম এফ. গ্লুয়েক (William. F. Glueck)-এর মতে, “নির্বাচন হলো একদল আবেদনকারী থেকে যোগ্যতমকে বা যোগ্যতমদেরকে খুঁজে বের করার প্রক্রিয়া।”এস. পি. রবিন্স ও কালটার (S. P Robbins and Coulter)-এর মতে, “সবচেয়ে সঠিক প্রার্থী নিয়োগের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য চাকরির আবেদনকারী বাছাইয়ের প্রক্রিয়াকে নির্বাচন বলে।”আর. এম. হাজেটস (R. M. Hodgetts)-এর মতে, “নির্বাচন হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যাতে নিয়োগের জন্য প্রার্থীগণকে দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়। এর একটি হলো যাদেরকে নিয়োগ প্রস্তাব দেওয়া হবে এবং অন্যদলকে নিয়োগ দেওয়া হয় না।
মনোবিজ্ঞানী টিনা অ্যাগেল (Tina Aghel)-এর মতে, আবেদনকারীদের মধ্য থেকে যাদের নতুন কার্যে সাফল্য অর্জনের সম্ভাবনা আছে, তাদের নির্বাচন করাকে কর্মচারী নির্বাচন বলে।”
মনোবিজ্ঞানী ডেল ইউডো (Dale Yoder) বলেন, “নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চাকরির জন্য আগ্রহী প্রার্থীদেরকে দুটো শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। একটি হল যাদেরকে চাকরি দেয়া হবে এবং অন্যটি হলো যাদেরকে চাকরি দেওয়া হবে না।”
মনোবিজ্ঞানী উইরিচ ও কুস্তে (Weihrich and Koontz)-এর মতে, “বর্তমান অথবা ভবিষ্যৎ পদ পূরণের জন্য প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তর বা বাইরের প্রার্থীদের মধ্যে থেকে সর্বাধিক উপযুক্ত প্রার্থী পছন্দ করার প্রক্রিয়াকে নির্বাচন বলে।”মনোবিদ এ. খালেক বলেন, “কর্মচারী নির্বাচন বলতে বুঝায়, কোনো বিশেষ কাজের জন্য দরখাস্তকারীদের মধ্য থেকে প্রয়োজনীয় সংখ্যক লোক খুঁজে বের করা এবং উপযুক্ত স্থানে উপযুক্ত ব্যক্তিকে নিয়োগ করা।”উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, কোনো শিল্প বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য আবেদনকারীদের মধ্য থেকে যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে খুঁজে বের করে যথাযথ স্থানে সঠিক ব্যক্তিকে নিয়োগ করার প্রক্রিয়াকে কর্মচারী নির্বাচন বলে।

কর্মচারী নির্বাচনের ক্ষেত্রে মনোবৈজ্ঞানিক অভীক্ষা : কর্মচারী নির্বাচনের ক্ষেত্রে নানা ধরনের পদ্ধতির মধ্যে | মনোবৈজ্ঞানিক বা মনস্তাত্ত্বিক অভীক্ষা অন্যতম। বিংশ শতকের শুরুর দিকে কর্মচারী নির্বাচনের জন্য মনোবৈজ্ঞানিক অভীক্ষার প্রচলন হয় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এর পরিধি ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে। প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য, প্রয়োগ পদ্ধতি ও উদ্দেশ্য অনুসারে মনোবৈজ্ঞানিক অভীক্ষাকে বিভিন্নভাবে শ্রেণিবিন্যাস করা হয়। তার মধ্যে প্রধান শ্রেণিবিভাগগুলো হলো।

ক. বুদ্ধি অভীক্ষা;

খ. বিশেষ প্রবণতা অভীক্ষা;

গ. ব্যক্তিত্ব অভীক্ষাঃ

ঘ. আগ্রহ অভীক্ষা এবং ৩. কৃতি অভীক্ষা।

ক. বুদ্ধি অভীক্ষা পরিবেশের সাথে খাপখাইয়ে চলার নিমিত্তে ব্যক্তির আচরণের পরিবর্তনশীলতাকে বুদ্ধিমত্তা বলে। কর্মচারীর যোগ্যতা পরিমাপের জন্য মনস্তাত্ত্বিক অভীক্ষার যতগুলো পদ্ধতি রয়েছে তার মধ্যে বুদ্ধি অভীক্ষা সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। বুদ্ধিমত্তা ব্যক্তির কতকগুলো সাধারণ গুণাবলি রয়েছে। এর মাধ্যমে ব্যক্তির বোধগম্যতা এবং বিচারশক্তি প্রকাশ পায়। তাছাড়া বৃদ্ধি অভীক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তির মানসিক ক্ষমতা ও তৎপরতা, কারণ অনুধাবন, দক্ষতা, বিচারশক্তি ইত্যাদি জানা যায়। এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে শ্রমিকের কার্যসম্পাদনের মাত্রা সম্পর্কে অনুমান করা যায়। সাধারণ বুদ্ধিমত্তা অভীক্ষাকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা : (১) একক বুদ্ধি অভীক্ষা এবং (২) যৌথ বুদ্ধি অভীক্ষা ।

১. একক বৃদ্ধি অভীক্ষা : এ ধরনের বুদ্ধি অভীক্ষা প্রত্যেক অভীক্ষার্থীর ওপর পৃথকভাবে প্রয়োগ করে প্রত্যেকের বুদ্ধি পরিমাপ করা হয়। এ অভীক্ষা আবার প্রধান দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা : (i) বিনেসিমো বুদ্ধি অভীক্ষা এবং (ii) ওয়েসলার বুদ্ধি অভীক্ষা ।

২. যৌথ বুদ্ধি অভীক্ষা : খুবই কম সময়ে একসঙ্গে অনেক লোকের বুদ্ধি পরিমাপের জন্য যৌথ বুদ্ধি অভীক্ষা তৈরি করা হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন একই সাথে অনেক সৈনিককে তাদের বুদ্ধি অনুযায়ী শ্রেণিবিন্যাসের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় তখন দুই ধরনের অভীক্ষা পদ্ধতি উদ্ভাবনের মাধ্যমে যৌথ বুদ্ধি অভীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। তারমধ্যে একটি আমি আলফা অপরটি আর্মি বিটা অভীক্ষা নামে পরিচিত।

খ. বিশেষ প্রবণতা অভীক্ষা : কর্মচারী নির্বাচনের জন্য অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ অভীক্ষা হলো বিশেষ প্রবণতা অভীক্ষা। কোনো একজন ব্যক্তি কোনো কাজের জন্য উপযুক্ত তা বিশেষ অভীক্ষার সাহায্যে খুব সহজে নির্ণয় করা যায়। কিন্তু বর্তমানে শিল্পভিত্তিক সমাজে বিভিন্ন প্রকারের এবং বিচিত্র বৃত্তি বা পেশার সৃষ্টি হয়েছে। যেকোনো ব্যক্তির পক্ষে সে যতই বুদ্ধিমান হোক না কেন সব ধরনের পেশায় সমান দক্ষতা অর্জন করতে পারে না। এমন কতকগুলো পেশা রয়েছে, যেখানে বুদ্ধির মাত্রা উঁচু না হলেও বিশেষ বিশেষ প্রবণতার অধিকারী ব্যক্তিরা ঐসব বুদ্ধিতে দক্ষতা লাভ করতে পারে। তাই ব্যক্তিবিশেষ ক্ষমতা পরিমাপের জন্য বিশেষ প্রবণতা অভীক্ষাকে প্রধান পাঁচ ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা :

১. পার্থক্যমূলক প্রবণতা অভীক্ষা : শিল্পক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা এবং বৃত্তি নির্বাচনে সহায়তার জন্য পার্থক্যমূলক প্রবণতা অভীক্ষার কার্যকারিতা সর্বজনস্বীকৃত। এটি একটি বহুমুখী প্রবণতা অভীক্ষাগুচ্ছ। এ অভীক্ষাগুচ্ছের রচনা করেছেন আমেরিকান মনোবৈজ্ঞানিক কর্পোরেশন এই অভীক্ষা গুচ্ছ অভীক্ষা নিয়ে গঠিত।

২. সাধারণ প্রবণতা অভীক্ষাসমূহ : আমেরিকার এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিস সরকারি কর্মচারী নিয়োগের জন্য ১৯৪৭ সালে এ অভীক্ষাগুচ্ছটি রচনা করেন। এ অভীক্ষাটি ১২ প্রকার অভীক্ষা নিয়ে গঠিত হলেও ৯ প্রকার অভীক্ষার সফলতা পাওয়া যায়।

৩. গিলফোর্ড জিমারম্যান প্রবণতা জরিপ : গিলফোর্ড এবং তাঁর সহযোগীরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিমান বাহিনীতে লোক নিয়োগের জন্য যে তথ্যসংগ্রহ করেন তার ওপর নির্ভর করে এই অভীক্ষার উদ্ভব হয়। এই অভীক্ষাটির সাতটি উপঅভীক্ষা রয়েছে। এটি শেষ হতে প্রায় ২ ঘণ্টা সময় লাগে ।

৪. সংবেদীয় প্রবণতা অভীক্ষা : সংবেদীয় প্রবণতা অভীক্ষাকে তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছে । যথা :

১. দর্শনমূলক অভীক্ষা, ২. শ্রবণমূলক অভীক্ষা,

৩. সঞ্চালনমূলক ক্ষমতা অভীক্ষা ।

৫. কারিগরি ক্ষমতা অভীক্ষা : কারিগরি ক্ষমতা অভীক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তির যন্ত্র চালনা ক্ষমতা, কারিগরি জ্ঞান ও বুদ্ধি, স্থান সম্পর্কে প্রত্যক্ষণ ক্ষমতা এবং সমন্বিত অঙ্গ সঞ্চালন ক্ষমতা পরিমাপ করা যায়।

গ. ব্যক্তিত্ব অভীক্ষা : উপযুক্ত কাজে উপযুক্ত লোক নিয়োগের জন্য ব্যক্তিত্ব অভীক্ষা খুবই কার্যকরী। ব্যক্তিত্ব অভীক্ষা ব্যবহার করে ব্যক্তির মানসিক কাঠামো, আত্মবিশ্বাস, আত্মপ্রত্যয়, মেজাজ, ভাবাবেগের ভারসাম্য, প্রেষণার কারণ ইত্যাদি পরিমাপ করা হয়। ব্যক্তিত্ব পরিমাপের জন্য অনেক অভীক্ষার উদ্ভব হয়েছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে মিনোসোট বহুমুখী ব্যক্তিত্ব অভীক্ষা, গিলফোর্ড, জিমারম্যান প্রবণতা জরিপ, গর্ডন ব্যক্তিত্ব অভীক্ষা এবং অভিক্ষেপণ পদ্ধতি ।

ঘ. আগ্রহ অভীক্ষা : ব্যক্তির সফলতা শুধু তার ঝোঁক বা প্রবণতার ওপরই নির্ভর করে না, আগ্রহের ওপরও বহুলাংশে নির্ভর করে। এজন্য কর্মী নিয়োগের পূর্বে ঐ পেশায় ব্যক্তির আগ্রহ বা আকর্ষণ যাচাই করে নির্বাচন করা প্রয়োজন। প্রার্থীদের মধ্যে কোনো ব্যক্তির কোন পেশায় কতটুকু আগ্রহ তা এ অভীক্ষাটির সাহায্যে সহজেই শনাক্ত করা যায়।

ঙ. কৃতি অভীক্ষা : কোনো প্রার্থীর বর্তমান দক্ষতা, যোগ্যতা বা সামর্থ্য পরিমাপ করার জন্য কৃতি অভীক্ষা ব্যবহার করা হয়। কর্মচারী নিয়োগ করার ব্যাপারে প্রার্থীদের বর্তমান সামর্থ্য বা দক্ষতা জানা প্রয়োজন হয়। কারণ এ বিষয়ে জানতে পারলে ভবিষ্যতে সে কাজে যোগদান করলে কতটুকু কাজ শিখতে পারবে সেক্ষেত্রেও অনুমান করা যায় ।

উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, উপরে উল্লিখিত প্রধান চারটি পদ্ধতি ব্যতীত শিল্পকারখানায় কর্মচারী নির্বাচনে আরও অনেকগুলো পদ্ধতি বা কৌশল ব্যবহৃত হয় তার মধ্যে বিশেষ প্রবণতা অভীক্ষা, ইন্দ্ৰিয়মূলক প্রবণতা অভীক্ষা, কারিগরি ক্ষমতা অভীক্ষা এবং কাহিনি সংপ্রত্যক্ষণ অভীক্ষা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ পদ্ধতি সঠিক এবং যথাযথভাবে ব্যবহার করে সহজেই কর্মের উপযোগী কর্মী নির্বাচন এবং নিয়োগ করা সম্ভব।