উত্তর: ভূমিকা: মনোবৈজ্ঞানিক অভীক্ষা হলো মানব মনোবৃত্তি, আচরণ, এবং ভাবনা সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং অধ্যয়নের একটি উপাদান। এটি মানব মনোবৃত্তি এবং মানসিক প্রক্রিয়ার সমঝনে সাহায্য করে, এবং এর মাধ্যমে মানব ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন দিক নিরীক্ষণ করা হয়। মনোবৈজ্ঞানিক অভীক্ষা ব্যক্তিগত মানসিক স্বাস্থ্য, বৃদ্ধি, মনোরোগ চিকিৎসা, শিক্ষা, ব্যবসায়, সামাজিক বৈপরীণ্য, এবং অন্যান্য ডোমেইনে ব্যবহার হয়।এই প্রয়োগে মনোবৈজ্ঞানিক গবেষণা উপাদানে পর্যাপ্ত ডেটা সংগ্রহণ, পর্যালোচনা, এবং নতুন ধারণা বিকাশে সাহায্য করে। এটি চিকিৎসকদের, শিক্ষাবিদদের, মানব সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে মানসিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি ব্যবসায়ে ও সামাজিক বৈপরীণ্যের পরিপরে প্রয়োগ করা হয়।এই বিজ্ঞানের প্রয়োগের উদাহরণ হতে পারে মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসা, যেমন মনোবিকারের চিকিৎসা, শিক্ষানিয়ন্ত্রণের উন্নতির সাথে শিক্ষা বৃদ্ধি, এবং ব্যবসায়ে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রয়োগ। এটি এমন গবেষণা থাকতে পারে যেখানে মানুষের বৈশিষ্ট্য, রুঝান, এবং প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সম্পর্ক নিরীক্ষণ করা হয়।মনোবৈজ্ঞানিক বা মনস্তাত্ত্বিক অভীক্ষা অভীক্ষা বলতে কোনকিছু পরিমাপের কৌশলকে বুঝায়। আর মনোবৈজ্ঞানিক অভীক্ষা বলতে বুঝায়, যার মাধ্যমে ব্যক্তির কোনো বিশেষ কার্যসম্পাদন করার মানসিক দক্ষতা ও মানবিক গুণাবলি রয়েছে কিনা তা যাচাই করা যায়। অন্যকথায় বলা যায়, ব্যক্তির কোনো বৈশিষ্ট্য বা আচরণের আদর্শাধিত পরিমাপকে মনোবৈজ্ঞানিক অভীক্ষা বলে। এ অভীক্ষার সাহায্যে ব্যক্তির কোনো বিশেষ কার্যসম্পাদন করার মানসিক এবং মানবিক গুণাবলি আছে কিনা তা যাচাই করা যায়। আর একটু সহজভাবে বলা যায়, মনোবৈজ্ঞানিক অভীক্ষা হলো | এমন একটি আধুনিক কৌশল, যার মাধ্যমে প্রার্থী সম্পর্কে পূর্ব থেকে অনুমান করা যায় এবং তাকে প্রশিক্ষণ দিলে সে কতটুকু সফলতা অর্জন করবে তা অনুধাবন করা যাবে।
মনোবিজ্ঞানী এনাসট্যাসি মনে করেন, “মনোবৈজ্ঞানিক অভীক্ষা বলতে বুঝায় ব্যক্তির মানসিক বৈশিষ্ট্যাবলির পরিমাণগত মূল্যায়ন বা পরিমাপের পদ্ধতি।” এ অভীক্ষা সম্বন্ধে তিনি আরও বলেন, মনোবৈজ্ঞানিক অভীক্ষা হলো কোনো আচরণের বস্তুনিষ্ঠ এবং আদর্শায়িত পরিমাপ।উপরিউক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায়, যে পদ্ধতিতে আচরণের সুনির্দিষ্ট মান নির্ধারণকল্পে কতকগুলো মানবিক গুণাবলি এবং বৈশিষ্ট্য যেমন- জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা, দক্ষতা, ব্যক্তিত্ব, ঝোঁক, আগ্রহ পরিমাণাত্মকভাবে পরিমাপ করা হয় তাকে মনোবৈজ্ঞানিক বা মনস্তাত্ত্বিক অভীক্ষা বলে।
মনোবৈজ্ঞানিক বা মনস্তাত্ত্বিক অভীক্ষার প্রয়োগ ব্যবহার : কর্মচারী বা শ্রমিক নিয়োগে মনোবৈজ্ঞানিক অভীক্ষার বহুল প্রয়োগ বা ব্যবহার লক্ষ করা যায়। নিচে নানা প্রকার মনোবৈজ্ঞানিক অভীক্ষার প্রয়োগ ব্যবহার পর্যালোচনা করা হলো :
১. বুদ্ধি অভীক্ষা : পরিবেশের সাথে খাপখাইয়ে চলার আচরণমূলক ক্ষমতাকে বুদ্ধিমত্তা বলে। কর্মচারীর যোগ্যতা মূল্যায়নে মনস্তাত্ত্বিক অভীক্ষার যেসব পদ্ধতি রয়েছে তার মধ্যে বুদ্ধি অভীক্ষা সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। বুদ্ধি ব্যক্তির কতকগুলো সাধারণ বৈশিষ্ট্য। এর সাহায্যে ব্যক্তির মানসিক ক্ষমতা ও তৎপরতা, কারণ অনুধাবন ক্ষমতা, বিচারশক্তি ইত্যাদি সম্বন্ধে অবগত হওয়া যায়। এর সাহায্যে পরবর্তীতে শ্রমিকের কার্যসম্পাদনের মাত্রা সম্পর্কেও অনুমান করা যায়। সাধারণ বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষার জন্য আবার তিনটি বিজ্ঞানসম্মত অভীক্ষা উদ্ভাবন করা হয়েছে। যথা :
ক. বিনেসিমোঁ বুদ্ধি অভীক্ষা,
খ.ওয়েসলার বুদ্ধি অভীক্ষা এবং
গ. যৌথ বুদ্ধি অভীক্ষা ।
ক. বিনেসিমো বুদ্ধি অভীক্ষা : ১৯০৫ সালে ফরাসি মনোবিজ্ঞানী আলফ্রেড বিনে এবং তাঁর সহযোগী সিমো শিশুদের বুদ্ধি পরিমাপের জন্য একটি অভীক্ষা তৈরি করেন। তারা শিশুদের উপযোগী করে সহজ হতে জটিল এবং জটিল হতে জটিলতর এভাবে ৩০টি প্রশ্ন রচনা করেন। প্রশ্নগুলো ছিল নানা প্রকারের। এ অভীক্ষার শিশুর বুদ্ধির নানা দিক প্রকাশ পেত। অভীক্ষাটিকে পরবর্তী সময়ে অনেকবার সংস্কার করা হয়।
খ. ওয়েসলার বুদ্ধি অভীক্ষা : ওয়েসলার বুদ্ধি অভীক্ষাটি মানসিক ডাক্তার ওয়েসলারের নামে পরিচিত। ১৯৩৯ সালে এই অভীক্ষাটি প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এই অভীক্ষাটি ভাষাগত এবং ভাষাবর্জিত উভয় প্রকার পদ নিয়ে গঠিত। বিনেসিমো বুদ্ধি অভীক্ষাটি ছিল শিশুদের জন্য উপযোগী কিন্তু ওয়েসলারের বুদ্ধি অভীক্ষাটি পরিণত বয়সের ব্যক্তিদের জন্য উপযোগী।
গ. যৌথ বুদ্ধি অভীক্ষা : কম সময়ে একসাথে অনেক লোকের বুদ্ধি পরিমাপের জন্য যৌথ বুদ্ধি অভীক্ষা উদ্ভাবন করা হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে যখন একই সাথে অনেক সৈন্যকে তাদের বুদ্ধি অনুযায়ী শ্রেণিবিন্যাসের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, তখন দুই প্রকার অভীক্ষা পদ্ধতি উদ্ভাবনের মাধ্যমে যৌথ বুদ্ধি অভীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। এদের একটি আর্মি আলফা এবং অপরটি ‘আর্মি বিটা’ অভীক্ষা নামে পরিচিত।
২. প্রবণতা অভীক্ষা : বুদ্ধিমত্তা অভীক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তির সামগ্রিক বা সাধারণ মানসিক ক্ষমতা পরিমাপ করা হয়। কিন্তু ঝোঁক বা প্রবণতা অভীক্ষার সাহায্যে ব্যক্তির বিশেষ পেশার জন্য কোন বিষয় শিক্ষণে প্রার্থীর বর্তমান বা সুপ্ত প্রতিভার পরিমাপ করা হয়। এ ঝোঁককে কোনো কোনো সময় ভবিষ্যৎ শিক্ষণ ক্ষমতাও বলা হয়। অর্থাৎ কোন প্রকারের প্রশিক্ষণ প্রদান করলে ব্যক্তি কতটুকু সফলতা অর্জন করবে তাই উক্ত ব্যক্তির প্রবণতা ।
৩. পেশাগত প্রবণতা অভীক্ষা : এ অভীক্ষার সাহায্যে দীর্ঘ। প্রশিক্ষণে কোনো ব্যক্তির সফলতা সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়। কিন্তু এটি কোনো সাধারণ বুদ্ধিমত্তার ওপর তেমন গুরুত্ব আরোপ করে না। শুধু বিশেষ পেশায় ব্যক্তির প্রবণতা কীরূপ তা নির্ণয় করা হয়। যেমন কোনো কম্পিউটার টাইপিস্টের টাইপ করতে তেমন কোনো বুদ্ধিমত্তার দরকার পড়ে না।
৪. পার্থক্যমূলক প্রবণতা অভীক্ষা : এটি আমেরিকার মনোবৈজ্ঞানিক কর্পোরেশন কর্তৃক রচিত একটি বহুমুখী ঝোঁক বা প্রবণতা অভীক্ষাগুচ্ছ। এ অভীক্ষাগুচ্ছটি কয়েকটি ছোট ছোট অভীক্ষার সমন্বয়ে গঠিত। যথা :
ক. বাকযুক্তি
খ. সংখ্যা ব্যবহার ক্ষমতা,
গ. বিমূর্ত যুক্তি,
ঘ. কারিগরি ক্ষমতা,
ঙ.করণিক প্রবণতা ইত্যাদি।
শিক্ষাক্ষেত্রে নির্দেশনা এবং পেশা নির্বাচনে সহায়তার জন্য এ অভীক্ষাগুচ্ছ বিশেষ তাৎপর্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।
৫. কারিগরি প্রবণতা অভীক্ষা : কারিগরি প্রবণতা অভীক্ষার সাহায্যে প্রার্থীর বর্তমান জ্ঞান এবং যোগ্যতার পরিমাপ করা হয়। সাধারণত সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিয়োগ প্রার্থীদের বর্তমান জ্ঞান এবং দক্ষতা এ পদ্ধতিতে বাছাই করা হয়, যাতে কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ব্যতিরেকেই তাদের নির্দিষ্ট কর্মে নিয়োগ করা যায়। কারিগরি প্রবণতা পরিমাপের জন্য অনেক অভীক্ষা উদ্ভাবিত হয়েছে। যথা :
ক. মিনোসোটা কারিগরি সংযোজন অভীক্ষা,
খ. মিনোসোটা স্থান সম্পর্ক অভীক্ষা এবং
গ. বেনেট কারিগরি বোধগম্যতা অভীক্ষা ইত্যাদি ।
৬. আগ্রহ অভীক্ষা : কর্মীর সাফল্য শুধু তার ঝোঁক বা প্রবণতার ওপরই নির্ভর করে না বরং তার আগ্রহের ওপরও বহুলাংশে নির্ভর করে। এজন্য কর্মী নিয়োগের আগে উক্ত পেশার ব্যক্তির আগ্রহ বা আকর্ষণ যাচাই করে নির্বাচন করা দরকার। প্রার্থীদের মধ্যে কোনো ব্যক্তির কোন পেশায় কতটুকু আগ্রত তা এই অভীক্ষার মাধ্যমে সহজে নিরূপণ করা যায়।
৭. ব্যক্তিত্ব অভীক্ষা : উপযুক্ত কর্মে উপযুক্ত লোক নিয়োগের জন্য ব্যক্তিত্ব অভীক্ষার গুরুত্ব খুব বেশি। ব্যক্তিত্ব অভীক্ষার সাহায্যে প্রার্থীর মানসিক কাঠামো, আত্মবিশ্বাস, মেজাজ, আত্মপ্রত্যয় ভাবাবেগের ভারসাম্য, প্রেষণার কারণ ইত্যাদি পরিমাপ করা হয়। ব্যক্তিত্ব পরিমাপের জন্য অনেক অভীক্ষা উদ্ভাবিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে জনপ্রিয় অভীক্ষা হচ্ছে মিনেসোটা বহুমুখী ব্যক্তিত্ব অভীক্ষা, গর্ডন ব্যক্তিত্ব অভীক্ষা, গিলফোর্ড ও জিমারম্যান প্রবণতা জরিপ এবং অভিক্ষেপণ পদ্ধতি।
মনস্তাত্ত্বিক অভীক্ষার সমালোচনা : মনোবৈজ্ঞানিক অভীক্ষা কর্মচারী নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি হলেও এটি পরিপূর্ণভাবে ত্রুটিমুক্ত নয়। অধিকাংশ সময়ই এর মাধ্যমে প্রাপ্ত ফলাফলের সাথে কর্মীর প্রকৃত কৃতকার্যতার সহ সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয় না। এছাড়া অনেকেই এর নিরপেক্ষতা সম্বন্ধে সন্দেহ পোষণ করে। অনেকে আবার একে ব্যক্তির গোপন বিষয়ে অনধিকার চর্চা বলে মনে করেন। তবে এসব দোষত্রুটি অতীনাংলোর অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার জন্য নয়, অভীক্ষার সঠিক প্রয়োগ বা অপব্যবহারেরই দেখা দেয়।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বা শিল্পকারখানায় কর্মী নির্বাচনে মনোবৈজ্ঞানিক অভীক্ষা একটি তথ্যভিত্তিক পদ্ধতি। মনোবৈজ্ঞানিক অভীক্ষাসমূহ সঠিক ও সুন্দরভাবে প্রয়োগ করে শিল্পকারখানায় অতি সহজেই উপযুক্ত কর্মচারী নির্বাচন করা সম্ভব। তাই সাম্প্রতিক কালে শিল্পোন্নত দেশে পর্যায়ক্রমে এর পরিধি ও বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।