বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক গুরুত্ব আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধ কী রাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল? আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক উন্নয়ন বা গুরুত্ব ব্যাখ্যা কর।
অথবা, “বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ রাজনৈতিক দিক দিয়ে কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ ছিল।” ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। বাংলাদেশ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত তৃতীয় বিশ্বের প্রথম দেশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের তুলনা ইতিহাসে বিরল। এ মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক। মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালির শত বছরের আত্ম অধিকার প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীন চেতনার চূড়ান্ত
বহিঃপ্রকাশ এবং এর মাধ্যমে বাংলার রাজনৈতিক অঙ্গনে এক মহা ঐক্যের সূচনা ঘটে। নিচে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক গুরুত্ব যথাপরিসরে বিভিন্ন আঙ্গিকে আলোচনা করা হয়েছে।৯৪
মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক গুরুত্ব : আমাদের মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক গুরুত্বকে পর্যালোচনা করতে হলে আমাদেরকে দুটি সময়কালের প্রেক্ষাপটে তা বিচার করতে হবে। যথা :
১. মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট বা স্বাধীনতা পূর্বকাল এবং
২. যুদ্ধোত্তর রাজনৈতিক গুরুত্ব। নিচে এ দু’পর্যায়ে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক গুরুত্ব পর্যালোচনা করা হলো :
১. মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট বা স্বাধীনতার পূর্বকালের মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্ব : ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের পর পরই এ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় ভাষা নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালিদের উপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিতে চাইলে বাঙালিরা তা মেনে নেয়নি এবং তীব্রভাবে এর প্রতিবাদ জানায়। যার ফলে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির মতো ঘটনা ঘটে। সাহসী
বাঙালিরা কখনো কারও কাছে মাথা নত করেনি এবং সাহস নিয়ে নিজের অধিকার আদায়ের জন্য প্রয়োজনে প্রাণ দিতেৎপারে ২১ ফেব্রুয়ারি ‘৫২ এ তাই প্রমাণ করে। বাংলার রাজনৈতিক আকাশে ২১ সবসময়ই চেতনা যুগিয়েছে। পরবর্তীতে আসে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের যুক্তফ্রন্টের ২১ দফাভিত্তিক নির্বাচন যাতে যুক্তফ্রন্ট ২২৮টি মুসলিম আসনের মধ্যে ২০৯টিই যুক্তফ্রন্ট লাভ করে। এতে প্রমাণ হয় যে, বাঙালিরা কোনো বিদেশি বা ভিন্ন জাতির উপনিবেশ হয়ে থাকতে
চায় না। ১৯৬২ সালে আইয়ুব সরকার পাকিস্তানের সংবিধানে বাঙালিদের প্রতি বৈষম্যনীতি গ্রহণ করলে পূর্ব বাংলার মানুষ
আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে উঠে। পাকিস্তান শাসনের অধীনে ক্রমাগত শাসন, শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে বাঙালিরা স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৬৬ সালে ৬ দফাভিত্তিক আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে যা পরবর্তীতে ১৯৬৮-‘৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলের
মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। ১৯৭০ সালে পূর্ব বাংলার আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও পশ্চিম পাকিস্তানিদের
ষড়যন্ত্রমূলক নীতির কারণে ক্ষমতায় আরোহণ করতে পারেনি, বরং ১৯৭১ সালের সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়।
এভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত স্ফুরণ ঘটে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। তাই দেখা যাচ্ছে বাঙালিরা
রাজনৈতিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতার চূড়ান্ত পর্যায় ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার এক চরম পর্যায় ছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ।
আর এজন্যই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ রাজনৈতিক দিক থেকে এত গুরুত্বপূর্ণ।
২. যুদ্ধোত্তর রাজনৈতিক গুরুত্ব : দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের সার্বিক তত্ত্বাবধানে বাঙালিদের নিয়ে পাল্টা বিভিন্ন বাহিনী গড়ে উঠে। এদের মধ্যে ছিল কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র যুবক, নারী, পুলিশ, আনসার, ই.পি.আর. (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস্), বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও অন্যদের নিয়ে গঠিত বিশাল
মুক্তিবাহিনী, প্রধানত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষিত তরুণদের নিয়ে গঠিত বেঙ্গল লিবারেশন ফোর্স (বি. এল. এফ. বা মুজিব বাহিনী), নৌ-কমান্ডো ইত্যাদি। এক পর্যায়ে পেশাদার সৈন্যদের নিয়ে নিয়মিত স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনী গঠিত হয়। এছাড়া দেশের অভ্যন্তরে ব্যক্তির উদ্যোগে আরো বেশ কিছু বাহিনী গড়ে উঠে, যার মধ্যে টাঙ্গাইলের বঙ্গবীর
কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম এর নেতৃত্বাধীন বাহিনী (যা ‘কাদেরিয়া বাহিনী’ নামে খ্যাত) বিশেষভাবে উল্লেখ্য। মুক্তিযুদ্ধকালীন সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক (Supreme Commander) ছিলেন অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । কর্নেল (পরে জেনারেল) এম.এ.জি. ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়।
৩. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনৈতিক দল : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল যে বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দল তাদের দলীয় কর্মসূচি নির্বিশেষে সম্মিলিত হয় এবং অস্থায়ী সরকারের সাথে একাত্মতা স্থাপন করে। কম্যুনিস্ট পার্টির বিভিন্ন উপদল, জাতীয় আওয়ামী পার্টির দুই অংশ এবং দেশের প্রত্যেকটি ছাত্র সংগঠন
এতে আত্মনিয়োগ করে। এভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের মাধ্যমে রাজনৈতিক সহনশীলতা এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের সংস্কৃতি গড়ে উঠে।
৪. মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বহির্বিশ্বের সমর্থন : মুক্তিযুদ্ধের সময় অস্থায়ী সরকার বাংলাদেশের জাতিসংঘসহ বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সমর্থন আদায়ে সক্ষম হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় এবং এর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে। এভাবে বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম ও একক রাষ্ট্র হিসেবে বহির্বিশ্বে পরিচিতি লাভ করতে থাকে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে একথা স্পষ্টত যে, বাংলাদেশ মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয় এবং আত্মমর্যাদা নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় বিশ্বের বুকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে। আর বাংলাদেশের এ স্বাধীনতা এসে রক্তক্ষয়ী এক সংগ্রামের মাধ্যমে লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে বাঙালি জাতির স্বাধীনচেতা রাজনৈতিক অঙ্গীকারের
স্বীকৃতিস্বরূপ। এজন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্ব অপরিসীম। কিংবা বলা যায়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম।