চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল ও কুফল আলোচনা কর।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল ও কুফল আলোচনা কর।
অথবা, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দোষ ও গুণের বিবরণ দাও।
অথবা, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল ও কুফলের বর্ণনা দাও।
অথবা, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের গুণসমূহ ও দোষসমূহ সমন্ধে তুমি যা জান বিস্তারিত লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : ১৭৬৫ সালে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার দেওয়ানি অধিকার লাভ করে। কোম্পানির দেওয়ানি লাভ করার ফলে একদিকে কোম্পানির কর্মচারীদের অত্যাচার, শোষণ, নির্যাতন, অন্যদিকে কতিপয় কর্মচারীর দুর্নীতির জন্য বাংলার ভাগ্যাকাশে নেমে আসে কালের করাল গ্রাস। তাই সংঘটিত হয় ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। এজন্য ব্রিটিশ সরকার কোম্পানিকে দায়ী করেন এবং ভারতবর্ষে নতুন একজন গভর্নর জেনারেল পাঠান। আর এভাবেই এক পর্যায়ে লর্ড কর্নওয়ালিস (১৭৮৬) সালে গভর্নর জেনারেল হয়ে ভারতবর্ষে আসেন। এর পরে অনেক আলোচনা-
সমালোচনার পর’১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ঘোষণা করা হয়।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. রাজস্ব আয় ও বাজেট সম্পর্কে ধারণা : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সম্ভাব্য দোষ-গুণ সম্পর্কে কর্নওয়ালিস বা ডাইরেক্টরস সভা যে অবহিত ছিলেন না এমন নয়। কোম্পানির রাজস্ব আয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া এবং বাৎসরিক বাজেটকে প্রস্তাবের সুবিধার জন্যই প্রধানত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হয়েছিল এবং এটাই ছিল এ বন্দোবস্তের প্রধান গুণ।
২. প্রজাসাধারণের সার্বিক উন্নতি : জমিদারগণ জমির মালিক হওয়ার ফলে প্রজা সাধারণের উপকার হয়। জমিদারগণ বাংলাদেশের অনেক স্থানে প্রজাবর্গের উপকারার্থে পুষ্করিণী খনন, বিদ্যালয়, চিকিৎসালয় প্রভৃতি স্থাপনের জন্য অকাতরে অর্থব্যয় করেন। দুর্ভিক্ষ ও মহামারির সময় জমিদারগণ প্রজাবর্গকে বাজানোর চেষ্টা করেন, যা ইতহাসে বিরল।
৩. ক্ষুদ্র শিল্পের উন্নতি : এ বন্দোবস্ত প্রবর্তন করার ফলে গ্রামাঞ্চলের ক্ষুদ্র শিল্পগুলোর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় উন্নতি লাভ করেছিল। তাই এদিক থেকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রয়োজনীয় ছিল।
৪. নতুন জমিদার শ্রেণির উদ্ভব : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে নতুন এক জমিদার শ্রেণির উদ্ভব হয়। এ জমিদার শ্রেণি কোম্পানি শাসনে স্বার্থ হাসিল করার জন্য সমর্থন জানায়। ফলে কোম্পানি শাসন টিকিয়ে রাখতে তারা অবদান রাখেন।
৫. কোম্পানির কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি : চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কোম্পানির কর্মচারীদের উপর রাজস্ব আদায়ের সাথে সাথে দায়িত্ব অর্পণ করেছিল। ফলে কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কুফল : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কুফল সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. খাজনা অনাদায়ে জমিদারি নিলাম : এ ব্যবস্থায় সান্ধ্য আইন প্রবর্তিত হওয়ার ফলে অনেক অনাদায়ী রাজস্বের অজুহাতে জমিদার জমিদারি হারান। ফলে দেখা দেয়, ২২ বছরের প্রায় অর্ধেক জমিদার ধ্বংস হয়।
২. রাজস্ব নির্ধারণের ত্রুটি : এ ব্যবস্থার অধীনে কী পরিমাণ জমি নিষ্কর ছিল, কী পরিমাণ জমিতে পশুচারণ ছিল তা খোঁজখবর না নিয়ে রাজস্ব নির্ধারণ করার ফলে রাজস্বের মাত্রা বেশি হয়েছিল। এতে জমিদারদের কাছ থেকে যে ধারণা পাওয়া যায় তাই ছিল একমাত্র ভিত্তি। ফলে রাজস্বকে কেন্দ্র করে অসংখ্য মামলা মকদ্দমা দেখা দেয়।
৩. জমির উপর চাপ বৃদ্ধি : এ ব্যবস্থার প্রবর্তনের ফলে জমির মালিকানা চিরস্থায়ী হওয়ার ফলে সকলেই যে কোনো উপায়ে জমি ক্রয় করার বা অধিকার করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলে জমির উপর ক্রমেই চাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এছাড়া জমি সংক্রান্ত অসংখ্য মামলা মকদ্দমা বিচারালয়গুলোতে আসতে থাকে।
৪. রায়তদের দুদর্শা : অতি উচ্চ হারে রাজস্ব নির্ধারণ হওয়ায় জমিদারগণ রায়তদের কাছ থেকে উচ্চ হারে খাজনা আদায় করতে বাধ্য হন। ফলে রায়তদের আর্থিক দুদর্শা বেড়ে যায়।
৫. সরকারের আর্থিক ক্ষতি : ১৭৯৩ সালে জমির যে মূল্য ছিল এ ব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ার পর তা দ্বিগুণ বেড়ে যায়।্যকিন্তু এতে সরকারের রাজস্ব বাড়ার কোনো উপায় ছিল না। ফলে সরকারে বর্ধিত মূল্যজনিত লাভের অংশ থেকে বঞ্চিত হয়।
৬. জমির উন্নয়ন ব্যাহত : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে বাংলার অর্থনৈতিক উন্নতি ব্যাহত হয়েছিল। কারণ জমিদারগণ্যস্থায়ী জমির মালিক হওয়ায় আর জমির উন্নয়নে কোনো ব্যবস্থা করেননি। অন্যদিকে, রায়তদের জমিতে তাদের কোনো্যঅধিকার না থাকায় তারা স্বভাবতই জমির উন্নয়নে মন দেয়নি।৭. নায়েব-গোমস্তাদের অত্যাচার : জমিদারগণ খাজনা আদায় করার জন্য যেসব নায়েব-গোমস্তা নিয়োগ করতেন।
তারা জনসাধারণকে নানাভাবে অত্যাচার করতেন। ফলে জনসাধারণের দুর্ভোগ আরো বেড়ে যায়। নায়েব্ গোমস্তাগণ নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য বায়তগণকে উৎপীড়ন করতে থাকেন। অনেকের মতে, এ ব্যবস্থার ফলে এক সামস্ত প্রথার সৃষ্টি করা হয়ছিল।
৮. গ্রামাঞ্চলের অবনতি : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে গ্রামের কৃষকদের শ্রম উৎপান্ন আয় হতে খাজনা আদায় করে এনে তা শহর এলাকায় ব্যয় করার ফলে গ্রামের আর্থিক সমৃদ্ধি দিন দিন হ্রাস পেতে থাকে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, কর্নওয়ালিস ১৭৯৩ সালে কোম্পানির রাজস্ব সমস্যার সমাধান এর জন্য যে বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন তা ছিল কোম্পানির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ভারতীয় জনসাধারণের স্বার্থের দিকে লক্ষ্য না করায় এটা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য হয়। কারণ এতে কেবল সুবিধা হয় জমিদারদের, লাভ হয় কোম্পানির। অন্যদিকে, বাংলার যে অবহেলিত কৃষককুল তাদের কোন উন্নতি হয়নি। তাই এ ব্যবস্থায় কর্নওয়ালিসের ভালো উদ্যোগ থাকলেও প্রায়োগিক দিক থেকে ছিল অনেকটা ত্রুটিপূর্ণ।