সামান্য কয় প্রকার ও কি কি

বৈশেষিক স্বীকৃত সাতটি পদার্থের দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ এবং সমবায় এ ছয়টি ভাবপদার্থ ।
সামান্য (Generality) : যে সাধারণ প্রকৃতির জন্য এক জাতীয় অনেক দ্রব্যকে একই নামে ডাকা হয় সে সাধারণ প্রকৃতিকে বলা হয় সামান্য। যেমন- রহিম, করিম, শফিক, আজাদ প্রমুখ বিভিন্ন মানুষের একটি সাধারণ প্রকৃতি আছে এবং সেটি হলো মনুষ্যত্ব। এই মনুষত্বের জন্যই রহিম, করিম, শফিক, আজাদ প্রমুখ বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে অল্প বিস্তর পার্থক্য
থাকা সত্ত্বেও তাদের মানুষ বলে ডাকা হয়। কাজেই ‘মনুষ্যত্ব’ মানব জাতির সামান্য। পাশ্চাত্য দর্শনে যাকে সার্বিক (Universal) বলা হয়, ভারতীয় দর্শনের সামান্য তারই অনুরূপ।
সামান্য সম্পর্কে ভারতীয় দর্শনের মত : সামান্য সম্পর্কে ভারতীয় দর্শনে তিন রকমের মতবাদ দেখা যায়। বৌদ্ধ দার্শনিকগণ বলেছেন, ‘সামান্য’ হলো নাম। সামান্যের ব্যক্তি বা বস্তু নিরপেক্ষ কোন সত্তা নেই। এক জাতীয় দ্রব্যকে একই নামে ডাকার অর্থ হলো তাদের ভিন্ন জাতীয় দ্রব্য হতে পৃথক করা। যেমন- কতকগুলো জন্তুকে গরু নামে অভিহিত করা হয়। এই জন্তুগুলোকে গরু নাম দেয়ার অর্থ এই নয় যে, এদের কোন একটি বা একাধিক সাধারণ প্রকৃতি আছে, যার জন্য এই গরু নামটি দেয়া হয়েছে। প্রকৃত কারণ এই যে, এরা অন্য নামধারী জন্তু (যেমন- বাঘ, কুকুর, বিড়াল ইত্যাদি) হতে পৃথক। পাশ্চাত্য তর্কশাস্ত্রে এই মতবাদকে নামবাদ (Nominalism) বলা হয়। জৈন ও অদ্বৈত বেদান্ত মতে, সামান্য এক জাতীয় দ্রব্যের নামও নয়, আবার দ্রব্যের অতিরিক্ত কোন পদার্থও নয়। সামান্য হলো একজাতীয় দ্রব্যে উপস্থিত কতকগুলো সমান গুণের সমষ্টি। যেমন- রহিম, করিম, শফিক, আজাদ প্রমুখ

ব্যক্তি মানুষ হিসেবে এক অন্য হতে পৃথক হলেও তাদের মধ্যে এমন কতকগুলো গুণ আছে (যেমন- জীববৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তি) যার জন্য তাদের একই জাতির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কাজেই মানুষ জাতির মনুষ্যরূপ সামান্য বলতে সকল মানুষের মধ্যে উপস্থিত সমান গুণের সমষ্টিকে বুঝায়। পাশ্চাত্য তর্কশাস্ত্রে এই মতবাদকে প্রত্যয়বাদ (Conceptualism) বলা হয়।
বৈশেষিক মতে সামান্য : ন্যায় বৈশেষিক মতে, সামান্য এক জাতীয় দ্রব্যের নামও নয়, আবার তাদের সমান গুণের সমষ্টিও নয়। সামান্য এক জাতীয় দ্রব্যের নাম ও সমান গুণের সমষ্টির অতিরিক্ত একটি নিত্য পদার্থ। সামান্য একজাতীয় দ্রব্যের প্রত্যেকটির মধ্যে উপস্থিত থাকলেও তার দ্রব্য নিরপেক্ষ একটি সত্তা আছে। দ্রব্যের উৎপত্তি ও বিনাশ আছে, কিন্তু
সামান্যের উৎপত্তি ও বিনাশও নেই। যেমন- প্রতিটি মানুষের জন্ম আছে, কিন্তু তার মনুষ্যত্ব অপরিবর্তিত থাকে। পাশ্চাত্য তর্ক ও দর্শনশাস্ত্রে এই মতবাদকে বাস্তববাদ (Realism) বলা হয় । ন্যায় বৈশেষিক মতে সামান্যের কোন সামান্য থাকে না। যেমন- মনুষ্যত্বের মনুষ্যত্ব থাকতে পারে না। কোন সামান্যের যদি সামান্য থাকে তবে তার আবার সামান্য থাকবে। এভাবে অনবস্থা দোষ (Fallacy of Infinite Regress) দেখা দেবে। আবার একজাতীয় দ্রব্যের একটি সামান্য থাকে। যেমন- মানুষ জাতির সামান্য কেবল মনুষ্যত্ব। একজাতীয় দ্রব্যের যদি একাধিক সামান্য থাকে তবে এই সামান্য বিপরীত বা বিরুদ্ধ প্রকৃতির হবে। ফলে শ্রেণিবিভাগ সম্ভব হবে না। যেমন- মানুষ জাতির সামান্য যদি মনুষ্যত্ব ও পাখিত্ব হয়, তবে মানুষের শ্রেণিবিভাগ সম্ভব নয়। কারণ তখন মানুষকে মানুষও বলা যাবে আবার পাখিও বলা যাবে। ন্যায়-বৈশেষিক মতে, সামান্য দেশে ও কালে থাকে না, কেবল দ্রব্য, গুণ ও কর্মে থাকে । বৈশেষিক দর্শনের এই মত বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদী বহু আধুনিক পাশ্চাত্য দার্শনিকও স্বীকার করেছেন।
ব্যাপকতা অনুসারে সামান্যের ভাগ : ব্যাপকতা অনুসারে সামান্যকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা :
১. পরা, ২. অপরা ও ৩. পরাপরা।
যে জাতি সর্বাধিক ব্যাপক, যে জাতিকে অন্য কোন জাতির অন্তর্ভুক্ত করা যায় না, তাকে পরা (Summum genus) বলা হয়। যেমন— সত্তা। যে জাতি সর্বাধিক কম ব্যাপক, যে জাতির অন্তর্ভুক্ত আর জাতি থাকে না, তাকে অপরা বলা হয়। যেমন- ঘটত্ব। পরা ও অপরার মধ্যবর্তী জাতির নাম পরাপরা। যেমন- দ্রব্যত্ব। দ্রব্যত্ব সত্তা হতে কম ব্যাপক কিন্তু ঘটত্ব হতে বেশি ব্যাপক।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বৈশেষিকদের পদার্থ সম্পর্কীয় মতবাদে সামান্য সম্পর্কে যে আলোচনা ও শ্রেণিবিভাগ করা হয়েছে তা দর্শনের আলোচনার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।