অথবা, আদিম সমাজের বৈশিষ্টগুসমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : বিবর্তনধারার একটি পর্যায়ে মানব অবয়ব সূচিত হয়। প্রাথমিক পর্যায়ের মানুষ ছিল উচ্ছৃঙ্খল, অসহায় ও সভ্যতা বিবর্জিত। তারা ছিল প্রকৃতির হাতের পুতুল, প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণের আওতাভুক্ত। প্রকৃতির রাহুগ্রাস থেকে অবমুক্ত হওয়ার মানসে এবং অস্তিত্বের যথার্থ সংরক্ষণে তারা পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীল হয়েছে, হয়েছে যূথবদ্ধ। নির্ভরশীলতার বাস্তবায়নের পথে তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে আন্তঃসম্পর্ক। আর এ আন্তঃসম্পর্কের পূর্ণাঙ্গ অবয়বে গড়ে উঠেছে সমাজ ।
আদিম সমাজের বৈশিষ্ট্য : আদিম সমাজের বৈশিষ্ট্য নিতে আলোচনা করা হলো :
১. খাদ্যের উৎস : আদিম সমাজ মূলত খাদ্যের জন্য প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল ছিল। প্রকৃতি অবারিত ফলমূল মুক্তহস্তে প্রদান করত। প্রকৃতির খাদ্যের উপর নির্ভর করেই মূলত তাদের জীবনযাত্রা সূচিত হয়। যদিও তারা পশুপাখিও শিকার করত। এছাড়া একটি মর্মান্তিক বিষয় হাজির হয় যেটা খুবই দুঃখজনক। মূলত আদিম সমাজে নরভক্ষণের কথাও অনেকের অজানা নয়। অর্থাৎ তারা নরমাংস ভক্ষণের বিরল দৃষ্টান্তের অধিকারী। অবশ্য আমাদের দেশে ১৭৭০ সালের মন্বন্তর এর সময়ে যেটা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে অভিহিত সেখানেও নরমাংস ভক্ষণের কথা জানা যায় এক সাংবাদিকের লেখায়।
২. খাদ্য সংগ্রহের কৌশল : খাদ্য সংগ্রহের জন্য আদিম সমাজের মানুষ বিভিন্ন জিনিস ব্যবহার করত। তাদের ব্যবহৃত জিনিসের মধ্যে কাঠ, হাড়, পাথর উল্লেখযোগ্য। পাথরের ব্যবহার তাদের জীবনায়তনকে অনেকটা সহজ করে তুলেছিল এবং তাদের অস্তিত্বের সংরক্ষণে পাথরের ভূমিকা ছিল। খাদ্য সংগ্রহের বিভিন্ন উপকরণ তাদের সংস্কৃতির নিদর্শন বহন করে।
৩. ভাষার ব্যবহার : আদিম সমাজের মানুষ অধিকাংশ সময় খাদ্যের সন্ধানে ব্যস্ত থাকত। আজকের খাবার পাওয়া গেলেও আগামীকাল খাবার পাওয়া যাবে কি না সেটা ছিল তাদের কাছে বড় প্রশ্ন। তাছাড়া খাদ্যের অন্বেষণে তাদেরকে হন্যে হয়ে ছুটতে হয়েছে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। সৃজনধর্মী কোনকিছু করার যথেষ্ট অবসর তাদের মধ্যে ছিল না। যে
কারণে তাদের মধ্যে কথাবার্তার আদানপ্রদান হয় নি। যদিও তারা বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে তাদের মনোভাব অন্যের সামনে তুলে ধরত এবং বিভিন্ন প্রয়োজন মিটাত।
৪. অবাধ যৌনাচার : আদিম সমাজের মধ্যে বিবাহের কোন নিয়মকানুন ছিল না। তাদের মধ্যে অবাধ যৌনাচার প্রচলিত ছিল। তারা তাদের দৈহিক চাহিদা পূরণে জোরজুলুমের আশ্রয় নিত। আদিম সমাজের পিতৃপরিচয়ের বিষয়টি ছিল অস্পষ্ট। সন্তানরা তাদের পিতৃপরিচয় জানত না এবং তাদের মায়েরাও এ ব্যাপারে অজ্ঞ ছিল। কেননা নারীরা বিভিন্ন
পুরুষের সাথে সংগমে লিপ্ত থাকত ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছা সত্ত্বেও। আদিম অর্থনীতি অত্যন্ত খারাপ থাকার কারণে সেখানে অধিকাংশ কন্যাসন্তানকে জন্মপরবর্তী সময়ে হত্যা করা হতো। তাদেরকে অর্থনীতির উপর চরম বোঝা মনে করা হতো। সে কারণে নারী সংকটের কারণে সেখানে বহুপতি বিবাহ প্রচলিত ছিল।
৫. পরিবার : আদিম সমাজের প্রাথমিক পর্যায়ে পরিবারের কোন অস্তিত্ব ছিল না। তাদের জীবন ছিল বর্বর এবং সভ্যতা বিবর্জিত ৷ বিভিন্ন প্রয়োজনের তাগিদে বিশেষ করে অস্তিত্বের সংরক্ষণে তারা দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করত। আর এ দলবদ্ধতা কিছুটা হলেও তাদের মধ্যে স্থায়িত্ব নিয়ে আসে। মূলত তারা গোষ্ঠীবদ্ধভাবে জীবনযাপন করত।
৬. আদিম সমাজের জীবন প্রণালী : আদিম সমাজের লোকেরা খাদ্যের জন্য প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল ছিল। আর অস্তিত্ব সংরক্ষণের মৌলিক প্রয়োজনই হলো খাদ্য। আর এ খাদ্য এক জায়গায় পাওয়া যেত না। তা বিভিন্ন স্থানে ছড়ানো ছিল। মূলত আবহাওয়ার পার্থক্য হেতু সব জায়গায় খাদ্যের উৎপাদন হতো না। আর খাদ্যের অন্বেষণে তারা বিভিন্ন জায়গায় ছুটে বেড়াত । এ কারণে তাদের জীবনটা ছিল মূলত কিছুটা যাযাবর প্রকৃতির।
৭. শ্রমবিভাগ : আদিম সমাজে সবাই মূলত খাদ্যের প্রয়োজনে তথা অস্তিত্বের প্রয়োজনে কাজ করত । শারীরিক যোগ্যতার মাপকাঠিতে তাদের মধ্যে শ্রমবিভাগ পরিলক্ষিত হয়। সাধারণত পুরুষরা ছিল অধিক পরিশ্রমী ও
শক্তিশালী। তাই তারা ভারি ও জটিল কাজ করত। অন্যদিকে, মহিলারা কিছুটা দুর্বল হওয়ায় তাদের দ্বারা সহজ সরল কাজগুলো সম্পন্ন হতো। পুরুষরা শিকারের কাজে ব্যস্ত থাকত এবং নারীর গৃহস্থালি ও সন্তান লালনপালনের কাজ করত।
৮. সম্পত্তির মালিকানা : আদিম সমাজে ব্যক্তিমালিকানা ছিল না। সম্পদে সবার অধিকার স্বীকৃত ছিল। তবে মালিকানার বিষয় নিয়ে বিভিন্ন আদিম সমাজ গবেষকদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা যায়। সেখানে ব্যক্তিমালিকানা না থাকলেও হাতিয়ারের উপর ব্যক্তিমালিকানা ছিল বলে অনেকেই মত প্রকাশ করেন।
৯. সমভোগবাদ : নৃবিজ্ঞানী হোয়াইট তাঁর একটি গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, সম্প্রদায়ের প্রযুক্তিবিদ্যা যত নিম্নস্তরের সম্প্রদায়ের জীবনযাপন প্রণালী ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রণালী তত বেশি সমতাবাদী এবং সদস্যরা পরস্পরের সাথে কর্তব্য ও দায়িত্ববোধে তত বেশি আবদ্ধ। আদিম সমাজের প্রযুক্তির বিষয়টি ছিল অতি নিম্নস্তরের। তাই সেখানে সাম্য থাকাটা খুবই
স্বাভাবিক বিষয়। মূলত আদিম সম্প্রদায়ের সদস্যরা একই কাজ করত, একই ধরনের খাদ্য গ্রহণ করত এবং একই ধরনের জীবনবৃত্ত পরিক্রমণ করত। তাই আদিম সমাজ ছিল মূলত সমভোগবাদী।
১০. ধর্ম : নৃবিজ্ঞানী টেইলর (E. B. Tylor) বলেছেন, “আদিম সমাজে ধর্ম ছিল সর্বপ্রাণবাদ। অন্যদিকে, তার শিষ্য বলেছেন মহাপ্রাণবাদ। আদিম সমাজের লোকের মধ্যে ধর্মের বিকাশ ঘটে এবং তাদের মধ্যে আত্মার ধারণা প্রকট হয় । তারা মৃতদেহকে কবর দিত। আদিম সমাজে ধর্মের চর্চা ছিল নানা আচার-অনুষ্ঠানে পরিপূর্ণ।
১১. সামাজিক শ্রেণীবিন্যাস : আদিম সমাজ ছিল সাম্যবাদী সমাজ। তাই সেখানে শ্রেণী ভেদাভেদ বেশি পরিলক্ষিত হয় না। তবে ব্যক্তিগত যোগ্যতাকে বিশেষ অনুষঙ্গ হিসেবে দেখা হতো। মূলত স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের জন্য সমাজে অনেকেই একটি বিশিষ্ট আসন পেত। তাছাড়া বয়স্ক ও প্রবীণদেরকে সমাজে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হতো।
১২. আগুনের আবিষ্কার : আদিম সমাজের মানুষ প্রাথমিক পর্যায়ে খাদ্যদ্রব্য বিশেষ করে মাংস কাঁচা খেত। কিন্তু এক পর্যায়ে আগুনের আবিষ্কার তাদেরকে মাংস ঝলসে খাওয়ার সুযোগ করে দেয়। আগুনের আবিষ্কার তাদের জীবনের গতি অনেকখানি পাল্টে দেয়। আগুনের আবিষ্কারই তাদেরকে একদিকে যেমন শীতের প্রকোপ থেকে রক্ষা করে, অন্যদিকে জীবনের নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্য প্রদান করে।
১৩. কুসংস্কার : আদিম সমাজের মানুষের মধ্যে কুসংস্কার পরিলক্ষিত হয়। ধর্মীয় বিধিনিষেধ তাদের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল । প্রকৃতপক্ষে কুসংস্কার ছিল তাদের ধর্মের অঙ্গ।
১৪. জাদু : জাদুবিদ্যা আদিম সমাজে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে ছিল। যারা জাদু দেখাত তাদেরকে দেবতার বংশধর বলে সম্মান করা হতো। সমাজে তাদের এ সম্মান তাদেরকে সমাজকাঠামোর একটি বিশেষ অঙ্গে পরিণত করে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, আমাদের সমাজ মূলত আদিম সমাজের নবসংস্করণ। আমরা আজ যে আধুনিক সমাজের সুফল ভোগ করছি তার জন্য আমরা আদিম সমাজের কাছে ঋণী। আদিম সমাজের মানুষ মূলত তাদের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য আনয়ন ও জীবনের প্রয়োজনেই দলবদ্ধ হয় এবং তাদের সম্পর্ক সূচিত হয়। এ
সম্পর্কের মাধ্যমেই গড়ে উঠে সমাজ।