পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশ ( ১৯৫৪ সালের নির্বাচন ):
১৯৫৪ সালের মার্চের ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭ টি মুসলিম (মোট আসন ছিল ৩০৯ টি) আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন অর্জন করে। তন্মধ্যে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৪৩ টি, শেরে বাংলা এ.
পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫৪ সালের ৮ থেকে ১২ মার্চ। অমুসলমানদের জন্য আসন সংরক্ষণ করে পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থায় পূর্ব বাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদের আসন সংখ্যা নির্ধারিত হয় ৩০৯টি। এর মধ্যে ২৩৭টি (৯টি মহিলা আসনসহ) মুসলমান আসন, ৬৯টি হিন্দু আসন (৩টি মহিলা আসনসহ), ২টি বৌদ্ধ আসন এবং ১টি খ্রিস্টান আসন। ১৯৫৩ সালের ১ জানুয়ারি যাদের বয়স ২১ বছর পূর্ণ হয়েছিল তাদেরকে ভোটার করা হয়েছিল। মোট ভোটার সংখ্যা ছিল ১,৯৭,৩৯,০৮৬ জন। আওয়ামী মুসলিম লীগ, কৃষক-শ্রমিক পার্টি এবং নেজামে ইসলাম ২১ দফার ভিত্তিতে ‘যুক্তফ্রন্ট’ গঠন করে। ২১ দফায় উল্লেখযোগ্য প্রতিশ্রুতিগুলি ছিল বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা, প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসন, শিক্ষা সংস্কার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, আইন পরিষদকে কার্যকর করা ইত্যাদি।
নির্বাচনে ২৩৭টি মুসলমান আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট লাভ করে ২১৫টি আসন, ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ পায় মাত্র ৯টি আসন। খেলাফতে রাববানী পার্টি ১টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা লাভ করে ১২টি আসন। পরে ৭ জন স্বতন্ত্র সদস্য যুক্তফ্রন্টে এবং ১জন মুসলিম লীগে যোগ দেন। মুসলিম লীগের পরাজয়ের পেছনে বহুবিধ কারণ ছিল। ১৯৪৭ এর পর থেকে দলটি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দলের অনেক ত্যাগী নেতা কর্মী দল থেকে বের হয়ে নতুন দল গঠন করেন।
১৯৪৭ থেকে ক্রমান্বয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যে বহুমুখী বৈষম্যের সৃষ্টি হয় তার দায় দায়িত্বও কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারে অধিষ্ঠিত মুসলিম লীগকেই বহন করতে হয়। ১৯৪৭ থেকে ৫৪ পর্যন্ত সময়ে পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি ঘটে, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রীর দাম বৃদ্ধি পায়। সর্বোপরি, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবির বিরোধিতা করে এবং ১৯৫২ সালের হত্যাকান্ড ঘটিয়ে মুসলিম লীগ বাংলার আপামর জনসাধারণকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পূর্ব বাংলার জনগণ যুক্তফ্রন্টকে ভোট দিয়ে প্রকারান্তরে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে জোরালো সমর্থন জানিয়েছিল। পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদে মুসলিম লীগের আসন হাতছাড়া হওয়ায় পাকিস্তান গণপরিষদে ওই দলের সদস্য সংখ্যা হ্রাস পায়। এর ফলে কেন্দ্রে কোয়ালিশন সরকার গঠন অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে যুক্তফ্রন্ট প্রাদেশিক সরকার গঠনের সুযোগ পায়। যুক্তফ্রন্ট প্রাপ্ত ২২২টি আসনের মধ্যে আওয়ামী মুসলিম লীগের আসন সংখ্যা ছিল ১৪২, কৃষক-শ্রমিক পার্টির ৪৮, নেজামে ইসলামের ১৯ এবং গণতন্ত্রী দলের ১৩।
যুক্তফ্রন্ট দলের প্রধান নেতা ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (আওয়ামী মুসলিম লীগ) এবং এ.কে ফজলুল হক (কৃষক-শ্রমিক পার্টি)। নির্বাচনে সোহরাওয়ার্দী ও ভাসানী অংশ গ্রহণ করেন নি এবং ফজলুল হককে সরকার গঠনের জন্য আমন্ত্রণ জানান হয়। শুরুতেই মন্ত্রিপরিষদ গঠন নিয়ে মনোমালিন্য শুরু হয় এবং যুক্তফ্রন্টের শরিক দলগুলির মধ্যে ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট হয়।
অবশেষে ১৫ মে আওয়ামী মুসলিম লীগের সংগে ফজলুল হকের আপোস হয় এবং তিনি এ দলের ৫ জন সদস্যসহ ১৪ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভা গঠন করেন। কিন্তু এ মন্ত্রিসভার আয়ু ছিল মাত্র ১৪ দিন। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী সাফল্য মুসলিম লীগ সরকার সুনজরে দেখে নি। তারা যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত করার চক্রান্ত করতে থাকে।
বিস্তারিত