আল্লমা ইকবালের খুদীতত্ত্ব আলোচনা কর।

অথবা, আল্লামা ইকবালের খুদী দর্শন সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, আল্লামা ইকবালের খুদীতত্ত্ব ব্যাখ্যা কর।
অথবা, আল্লামা ইকবালের খুদীতত্ত্ব বর্ণনা কর।
অথবা, আল্লামা ইকবালের খুদীতত্ত্ব বিশ্লেষণ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : মুসলিম দর্শনের ইতিহাসে আল্লামা ইকবাল বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। তিনি মুসলিম দর্শনে প্রাচ্যের আধ্যাত্মবাদ ও পাশ্চাত্যের বাস্তুবাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছেন। তিনি পাশ্চত্যের সেসব দিক গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলেন, যেগুলো ইসলামের মূল শিক্ষার পরিপন্থি ছিল না। ইসলামি শিক্ষার যে দৃষ্টিভঙ্গি তা পুনর্জাগরণে তার অবদান অপরিসীম। তাই অনেক চিন্তাবিদ মনে করেন, আল-গাজালির পর যদি এমন কোন চিন্তাবিদ থেকে থাকেন যিনি মুসলিম দর্শনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি হলেন আল্লামা মোহাম্মদ ইকবাল।
আল্লামা ইকবালের জীবনী : ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের শিয়ালকোটে ইকবাল জন্মগ্রহণ. – করেন। বাল্যকাল থেকেই তিনি তার প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। শৈশবে জন্মস্থানেই প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। মীর হাসান নামক বিশিষ্ট ইসলামি পণ্ডিতের কাছে তিনি ইসলামি সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ পান। এরপর তিনি
প্রাচ্যবিদ্য বিশারদ টমাস আর্নল্ডের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৯০৫ সালে তিনি ইংল্যান্ডের ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় হতে
এম. এ ডিগ্রি লাভ করেন। এরপরে জার্মানির মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয় হতে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। ইউরোপ হতে দেশে ফিরে ১৯০৮ সালে লাহোর সরকারি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। তার উল্লেখযোগ্য দু’টি গ্রন্থ হলো, The
Development of Metaphysics in Persia’ ও ‘Reconstruction of Religious Thought in Islam’. ১৯৩৮ সালে লাহোরে এ মহান চিন্তাবিদ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
ইকবালের খুদীতত্ত্ব : ইকবালের দর্শনের একটি বিশেষ দিক হলো তার খুদীতত্ত্ব। তিনি খুদী বলতে আত্মা বা আত্মসত্তাকে নির্দেশ করেছেন। মূলত এ খুদীতত্ত্বকে কেন্দ্র করে তার সমগ্র দর্শন চিন্তা আবর্তিত হয়েছে। নিম্নে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :
খুদী বাস্তব : ইকবালের মতে, খুদী হলো বাস্তব সত্তা। এটি তার নিজস্ব শক্তির উপর ভিত্তি করে অস্তিত্বশী রয়েছে। খুদী বলতে বুঝায় অহং। সর্বেশ্বরবাদী বা সর্বখোদাবাদীরা খুদী বা অহং এর অস্তিত্বকে অবাস্তব ও অলীক ধারণা
বলে মনে করেন। তারা বলেছেন, আত্মা শাশ্বত মনের একটি অসম্পূর্ণ বিকার বা প্রতিফলন। এ অসম্পূর্ণ আত্মার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হলো পরমসত্তার সাথে বিলীন হয়ে যাওয়া। প্রথমদিকে সর্বখোদাবাদ দ্বারা প্রভাবিত হলেও পরবর্তীতে তিনি এ হতে বের হয়ে আসেন। তার প্রধান অভিযোগ ছিল যে, বস্তু সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানকে অস্বীকার করা যায় না।
যেমন- জগৎ অস্তিত্বশীল। একে আমরা অস্বীকার করতে পারি না। খুদী বা অহং এর অস্তিত্বকে সর্বখোদাবাদীরা একেবারে
উড়িয়ে দিতে পারেন না। বাস্তব জগতের অস্তিত্ব প্রমাণ করা সর্বখোদাবাদীদের পক্ষে অপরিহার্য এবং প্রমাণের ক্ষেত্রে হয় জগৎকে খোদা হতে নিঃসৃত নতুবা অসম্পূর্ণ প্রকাশ হিসেবে গ্রহণ করা ছাড়া অন্য পন্থা খোলা নেই। অর্থাৎ, তারা পরিদৃশ্যমান জগৎকে অবাস্তব ও অলীক বলে মনে করেছেন। জগৎ সত্তার অস্বীকৃতি মানুষ ও তার নৈতিক ও সামাজিক
দায়িত্ব, কর্তব্য, আশা-আকাঙ্ক্ষার বিলুপ্তি ঘোষণা করে। এভাবে ব্যক্তিগত জাতীয় জীবনের সকল অগ্রগতি ও কর্মচাঞ্চল্যকে
স্তব্ধীভূত করে দিয়ে এক সীমাহীনতা, কর্মহীনতা ও শূন্যতা ঘোষণা করে সর্বখোদাবাদ।
সর্বখোদাবাদের সমালোচনা : ইকবাল তার দার্শনিক চিন্তার প্রাথমিক স্তরে সর্বখোদাবাদ দ্বারা আলোড়িত হলেও পরবর্তীতে তিনি এর মধ্যে অসারতা খুঁজে পান। তার যুক্তি হলো সংবেদনাত্মক ও প্রত্যক্ষজাত জ্ঞানকে আমরা
কোনভাবেই অস্বীকার করতে পারি না। যদিও সর্বখোদাবাদীরা জাগতিক জ্ঞানের অসারতা প্রমাণ করতে চেয়েছেন তবুও তারা এর মাধ্যমে তাদের নিজস্ব মতকে প্রমাণ করতে পারেন নি। তাছাড়া খুদীর অস্তিত্ব প্যানথিজমের পরিপন্থি। তাছাড়া
সর্বখোদাবাদীরা খুদীর বাস্তব অস্তিত্বকে একেবারে অস্বীকার করতে পারেন নি। সর্বখোদাবাদের সমলোচনায় ইকবাল
দেখান যে, আত্মা বাস্তব ও অস্তিত্বশীল। কাজেই পরম সত্তায় আত্মবিলুপ্তি খুদী বা অহং এর লক্ষ্য হতে পারে না, বরং এটি খুদীর বৈশিষ্ট্যের পরিপন্থি। আমরা বলতে পারি না যে, আমরা অস্তিত্বহীন অবাস্তব, কেননা এ অবস্থা আমাদের চিন্তার সাথে বা চিন্তার সাধারণ নিয়মের সাথে সামঞ্জস্য নয়।
খুদীকে জানার উপায় : অতীন্দ্রিয় অনুভূতির মাধ্যমে আমরা খুদীকে সরাসরি জানতে পারি। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ, অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে অনুমান প্রভৃতি খুদীর অস্তিত্বকে প্রমাণ করে। আমাদের সব ক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে মূলত খুদী অবস্থান করে। খুদী মূলত মানসিক অবস্থা অভিজ্ঞতা হতে পৃথক সত্তা। তবে এক্ষেত্রে ইকবাল বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদ
পরিবর্জন করেন এবং স্বজ্ঞার মাধ্যমে আত্মার স্বরূপ উদ্ঘাটন করেন। তাঁর মতে, স্বজ্ঞার মাধ্যমে আত্মা বা খুদীর প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়, তবে প্রচলিত ভাষায় খুদীর স্বরূপ বর্ণনা করা যায় না। তাছাড়া ভাষায় মাধ্যমে এটি বর্ণনা করা অনেকটা
বিপদসঙ্কুলও বটে । কেবল অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বা নিজস্ব স্বজ্ঞার মাধ্যমে বা সাক্ষাৎ উপলব্ধির মাধ্যমে এর প্রকৃতি জানা যায় ।
খুদীর সাথে ইচ্ছার রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। ইচ্ছা ও কর্মবিহীন মানুষ জীবন বিবর্জিত ও নিষ্প্রাণ। প্রচেষ্টা ও ইচ্ছার দিকে মানুষ যতই অগ্রসর হবে, জীবনের পথে সে ততটুকু উন্নত হবে। ইচ্ছাময় জীবনই সম্প্রসারণশীল। ইচ্ছাই জীবনের বিভিন্ন দিগন্ত মানুষের নিকট ব্যক্ত করে, ইচ্ছার শক্তি আমাদের ব্যক্তিত্বের উৎস। ইচ্ছার ক্রমবর্ধমান সম্প্রসারণশীলতার
ফলে খুদী শক্তিশালী ব্যক্তিত্বে রূপ লাভ করে ।
প্রেম ও খুদী : খুদীর একটি বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো প্রেম। প্রেম আমাদের ইচ্ছাকে সক্রিয় করে। প্রেম জীবনের নতুন অর্থকে নির্দেশ করে। তাছাড়া. প্রেম খুদীকে সুরক্ষিত করে। খুদীকে কোন অবস্থায়ই যান্ত্রিক পরিবেশের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করা যায় না, বরং খুদী নিজেই নিজেকে নিয়ন্ত্রিত করে। আমরা দেখি যে, ইতর প্রাণী যেখানে সহজাত প্রবৃত্তির দ্বারা তার পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেয় বা খাপখাইয়ে নেয়। সেখানে মানুষ তার উদ্দেশ্যর বলে বলীয়ান হয়ে পরিবেশকে
নিয়ন্ত্রিত করে। মানুষ তার ইচ্ছার বলে তার অহংকে বা খুদীকে জাগ্রত করে। ইচ্ছার বলে বলীয়ান খুদী এবং প্রেমের দ্বারা শক্তিমান অহং স্বাধীনভাবে কোন প্রভাব ছাড়াই অস্তিত্বশীল থাকে। শুধু তাই নয়, সে এর মাধ্যমে তার পরিবেশকেও নিয়ন্ত্রণ করে যা অন্যান্য প্রাণীর দ্বারা সম্ভব নয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, উপমহাদেশের একজন প্রখ্যাত দার্শনিক হিসেবে আল্লামা ইকবালের খুদীতত্ত্ব ব্যাপক প্রভাববিস্তার করে। তাঁর সমগ্র দার্শনিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে খুদী অহং এর ধারণা বিদ্যমান। এটাই তাঁর দর্শনের ভিত্তি। তাঁর এ খুদী বা আত্মসত্তা হলো বাস্তব এবং তাকে জানা যায়। আর খুদীকে জানার সর্বোত্তম পথ হলো সজ্ঞা। তিনি খুদীকে জানার মাধ্যমে মুসলমানদের নবজাগরণে আহ্বান জানিয়েছেন। খুদী দর্শন তাঁর শ্রেষ্ঠ অবদান।
মুসলিম দর্শনে এটি মৌলিক ধারণা হিসেবে গৃহীত হয়েছে।