অথবা, ইবনে রুশদ আল্লাহর জ্ঞান নিয়ে দার্শনিক ও ইমাম আল গাজালির বিবাদকে কিভাবে দেখেছেন?
অথবা, আল্লাহর জ্ঞান নিয়ে দার্শনিক ও ইমাম আল গাজালির মধ্যে যে বিবাদ সে সম্পর্কে ইবনে রুশদ কী বলেছেন?
অথবা, ইবনে রুশদ আল্লাহর জ্ঞান নিয়ে দার্শনিক ও ইমাম আল গাজালির বিবাদ সম্পর্কে কী মন্তব্য করেন আলোচনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা : ইবনে রুশদ মুসলিম জাহানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক হিসেবে পরিগণিত। ইউরোপীয়রা তাকে সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম দার্শনিক ও এরিস্টটলের প্রখ্যাত ভাষ্যকার হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ইবনে রুশদ বিশ্বাস করেন যে, একটি সত্যিকারের ধর্ম হিসেবে ইসলাম দর্শন চর্চার বিরোধী নয়। বরং দর্শনের অধ্যায়নকেই উৎসাহিত করে। এরিস্টটলের
দর্শনের প্রতি তার অকুণ্ঠ সমর্থন ও আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য এবং এরিস্টটলের অভিমতকে কেন্দ্র করে ইসলামের ব্যাখ্যা দেয়ার অভিযোগে গোঁড়া রক্ষণশীল ধর্মতত্ত্ববিদরা তাকে ধর্মবিরোধী বলে অভিহিত করেন।
আল্লাহর জ্ঞান সম্পর্কে ধারণা : আল্লাহর জ্ঞান নিয়ে বিভিন্ন সময়ে মতবিরোধ লক্ষ্য করা যায়। ইমাম আল গাজালি আল্লাহর জ্ঞান সম্পর্কে দার্শনিকদের মতের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। ফালাসিফা সম্প্রদায়ের দার্শনিকদের মতে, আল্লাহর শুধু সার্বিক জ্ঞান রয়েছে, বিশেষ জ্ঞান নেই। দার্শনিকদের এ ধরনের বক্তব্যের বিরোধিতা করে গাজালি বলেন যে, আল্লাহ সবকিছুই জানেন, তিনি সার্বিকভাবেও জানেন আবার বিশেষভাবেও জানেন। দার্শনিক ও গাজালির এ ধরনের
মতামতের মধ্যস্থতায় ইবনে রুশদ যুক্তি প্রদান করেন। তিনি বলেন যে, এক ধরনের ভুল বুঝাবুঝির মাধ্যমে দার্শনিকদের সাথে গাজালির মতবিরোধ সৃষ্টি হয়।
আল্লাহর সার্বিক জ্ঞান আছে, বিশেষ জ্ঞান নেই-এর পক্ষে দার্শনিকদের যুক্তি : ফালাসিফা
সম্প্রদায়ের কিছু দার্শনিকদের মতে, আল্লাহর শুধু সার্বিক জ্ঞান আছে, বিশেষ জ্ঞান নেই। তাদের এ মতবাদের পক্ষে যেসব যুক্তি উপস্থাপন করেছেন তা নিম্নরূপ :
১. বিশেষ জ্ঞান পরিবর্তনশীল : আল্লাহর জ্ঞান সম্পর্কে দার্শনিকগণ বলেন যে, বিশেষ জ্ঞান পরিবর্তনশীল ও খণ্ড খণ্ড। অন্যদিকে, জ্ঞানের সাথে জ্ঞাতার সত্তায় পরিবর্তন আসে। অনন্ত তার মনোজগতের পরিবর্তন সূচিত হয়। যদি
আল্লাহর বিশেষ জ্ঞান তথা খণ্ড খণ্ড জ্ঞান থাকে, তাহলে তার সত্তায় পরিবর্তন দেখা দিবে। তবে আল্লাহর সত্তায় পরিবর্তন আশা করা যায় না। সুতরাং আল্লাহর সার্বিক জ্ঞান রয়েছে।
২. বিশেষ জ্ঞান কালিক : দার্শনিকগণ আল্লাহর জ্ঞান প্রমাণ করতে গিয়ে বলেন যে, বিশেষ জ্ঞান কালিক সম্পর্কের দ্বারা সীমাবদ্ধ। এ কালিক জ্ঞান আল্লাহর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না। কেননা আল্লাহর জ্ঞান কোনকিছু দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বা সীমাবদ্ধ হতে পারে না। অতএব আল্লাহর সার্বিক জ্ঞান আছে, কোন বিশেষ জ্ঞান নেই।
৩. বিশেষ জ্ঞান বিশেষ সম্পর্কে আবদ্ধ : দার্শনিকগণ বলেন যে, কোন বিশেষ বস্তু বা ঘটনার জ্ঞান লাভ করার অর্থ ঐ বিশেষ বস্তু বা ঘটনার সাথে কোন বিশেষ সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া । তবে এরকম কোন বিশেষ সম্পর্কের বন্ধনে আল্লাহ আবদ্ধ হলে তিনি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েন, কিন্তু তা সম্ভব নয়। তাই আল্লাহর শুধু সার্বিক জ্ঞান আছে বলে দার্শনিকগণ মনে করেন।
গাজালি কর্তৃক দার্শনিকদের যুক্তি খণ্ডন : দার্শনিকগণ আল্লাহর জ্ঞান সম্পর্কে যে যুক্তি দিয়েছেন তা ইমাম গাজালি প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর মতে, আল্লাহ সবকিছুই জানেন। তিনি সার্বিক ও বিশেষ উভয়ই জানেন। নিম্নে গাজালি ।
যেভাবে দার্শনিকদের মতবাদ খণ্ডন করেছেন তা তুলে ধরা হলো :
প্রথমত, ইমাম গাজালি দার্শনিকদের প্রতিবাদ করে বলেন যে, তাদের এ মতবাদ শরিয়ত বিরোধী। আল্লাহ জগতের সকল খুঁটিনাটি ঘটনাসমূহ শরিয়ত অনুযায়ী সবিশেষ পরিজ্ঞাত। দ্বিতীয়ত, দার্শনিকদের মতবাদের বিরোধিতায় গাজালি বলেন যে, প্রকৃত সত্যের কখনো পরিবর্তন হয় না। আল্লাহ যা জানেন তা প্রকৃতভাবে জানেন, ফলে তার জ্ঞানে পরিবর্তন আসতে পারে না। আল্লাহর বিশেষ ঘটনারও প্রকৃত অবস্থা জানেন। সুতরাং আল্লাহর সার্বিক ও বিশেষ সব জ্ঞানই রয়েছে।
তৃতীয়ত, ইমাম আল গাজালি দার্শনিকদের মতবাদ খণ্ডন করে বলেন যে, মানুষের সার্বিক জ্ঞান সীমিত। আর আল্লাহর সার্বিক জ্ঞান কোনকিছু দ্বারা সীমিত নয়। ফলে তার সার্বিক জ্ঞানের সাথে বিশেষ জ্ঞান বিরোধপূর্ণ হয় না।
ইমাম আল গাজালির বিরুদ্ধে ইবনে রুশদের মতবাদ : দার্শনিকগণের যুক্তিসমূহ এবং ইমাম আল গাজালির বিরোধিতা সম্পর্কে ইবনে রুশদ পর্যালোচনা করে আল্লাহর জ্ঞান সম্পর্কে অভিমত ব্যক্ত করেন। নিম্নে ইবনে
রুশদের মতামতসমূহ তুলে ধরা হলো :
১. ঐশী জ্ঞান মানবীয় জ্ঞানের সাথে একীভূত করা : ইবনে রুশদ বলেন যে, আল গাজালির সাথে দার্শনিকদের মতবিরোধের মূল কারণ হচ্ছে ঐশী জ্ঞানকে মানবীয় জ্ঞানের সাথে একাকার করে দেখা। তার মতে, ঐশী জ্ঞান বা
আল্লাহর জ্ঞান সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির জ্ঞান। এ জ্ঞানের মানুষের জ্ঞানের তুলনা করা চলে না, তা সার্বিক হোক আর বিশেষ হোক। আল্লাহর জ্ঞানের মাধ্যমে, জ্ঞানের প্রকৃতি সবকিছুই মানুষের জ্ঞানের থেকে ভিন্ন প্রকৃতির হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে দার্শনিকগণ ও গাজালি উভয়ই একই মানদণ্ডে ঐশীজ্ঞান ও মানবীয় জ্ঞানকে বিচারবিশ্লেষণ করেছেন। সুতরাং তাদের মধ্যে অহেতুক বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
২. সার্বিক ও বিশেষ জ্ঞান : ইবনে রুশদ বলেন, মানুষ বিশেষ বিশেষ জ্ঞান লাভ করে ইন্দ্রিয়ের দ্বারা বা ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার দ্বারা। আর সার্বিক জ্ঞান লাভ করে বুদ্ধি দ্বারা। তবে ঐশ্বরিক জ্ঞান কি সেভাবে উৎপত্তি লাভ করে? মানুষের
জ্ঞানের পবিরর্তন হলে জ্ঞাতার পরিবর্তন হতে পারে। কারণ মানুষের জ্ঞান জ্ঞেয়বস্তু বা বিষয়ের পরিবর্তনের সাথে পরিবর্তিত হয়। তবে আল্লাহর জ্ঞান জ্ঞেয়বস্তুর সাথে এভাবে সম্পর্কিত নয়।
৩. পরোক্ষ বিষয় : ইবনে রুশদের মতে, মানবীয় জ্ঞান তা সার্বিক হোক আর বিশেষ হোক এটা এক ধরনের ফল এবং এটা অভিজ্ঞতা অথবা বুদ্ধি যার দ্বারাই উৎপন্ন হোক না কেন এটা একটি পরোক্ষ ব্যাপার। কারণ মানুষের বুদ্ধি এবং ইন্দ্রিয় শক্তি তার কোন স্বকীয় বিষয় নয়। এটা আল্লাহর নিকট থেকে প্রাপ্ত। কিন্তু আল্লাহ যে কোন ঘটনাই স্বয়ং কারণ । সুতরাং মানবীয় জ্ঞানের মতো করে আল্লাহর জ্ঞানকে বিচার করা চলে না।
৪. আল্লাহর সত্তার পরিবর্তন নেই : ইবনে রুশদের মতে, আল্লাহ সার্বিক বিশেষ যাই জানুক না কেন তাতে তার সত্তার কোন পরিবর্তন আসতে পারে না এবং বহুত্বও আসতে পারে না। কারণ আল্লাহ এসবকে মূল জ্ঞান থেকেই বা উৎস থেকেই জানেন। আল্লাহ যদি কোন বিশেষ বিষয় সম্পর্কে জানেন, তাহলে ঐ বিশেষ বিষয়ের উৎপত্তি থেকেই জানেন। সুতরাং তার জ্ঞান এখনো পরিবর্তনযোগ্য নয়। তিনি অপরিবর্তনীয় সঠিক জ্ঞানই রাখেন ।
দার্শনিক মূল্যায়ন : ইমাম আল গাজালি এবং দার্শনিকদের মধ্যে আল্লাহর জ্ঞান নিয়ে যে মতবিরোধ তা মূলত দার্শনিক বিতর্কের বিষয়। গাজালি যেভাবে দার্শনিকদের মতবাদকে শরিয়ত বিরোধী বলেছেন তা যুক্তিযুক্ত নয়। কেননা দার্শনিকগণ আসলে দার্শনিক বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। তবে তাদের ধর্মকে আঘাত করার লক্ষ্য ছিল না। তারা আল্লাহর একত্বকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। যার প্রেক্ষাপটে তারা আল্লাহর বিশেষ জ্ঞানের পরিবর্তনে সার্বিক জ্ঞানের কথা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ এক সার্বিক জ্ঞান রাখেন, যার মধ্যে সকল বিশেষ জ্ঞান অন্তর্ভুক্ত। তাহলে দার্শনিকদের মতবাদের মধ্যে কোন অসংগতি থাকে না। মূলত আল্লাহ সব বিশেষ জ্ঞানের উৎস থেকেই জানেন। ফলে তিনি সবকিছুতেই অবগত, তবে
মানুষের মতো পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়ায় অবগত নন। সুতরাং দার্শনিকদের মতবাদকে অস্বীকার করা যায় না।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনায় বলা যায় যে, দার্শনিকগণ এবং ইমাম আল গাজালির মধ্যে দ্বন্দ্ব তা মূলত এক ধরনের ভ্রান্ত মতবিরোধ। এ প্রসঙ্গে ইবনে রুশদ বলেছেন যে, দার্শনিকগণ ইসলামি শরিয়তের বিরোধিতা করতে চান নি। আর অপরদিকে, ইমাম গাজালি যথাযথভাবে আল্লাহকে সর্বজ্ঞানী বলে উল্লেখ করেছেন। সুতরাং তিনি বুঝাতে চেয়েছেন আল্লাহর জ্ঞা ও মানুষের জ্ঞানকে কখনই এক করে দেখা সম্ভব নয়। অতএব মুসলিম দর্শনে ইবনে রুশদের অবদান অনস্বীকার্য।