অথবা, যুবকদের সমস্যা সমাধানে সমাজকর্মীর অবদান আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের যুবকদের সমস্যা সমাধানে একজন পেশাদার সমাজকর্মী কী কী ভূমিকা পালন করে আলোচনা কর।
অথবা, যুবকদের বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে সমাজকর্মীর ভূমিকা তুলে ধর।
উত্তর৷ ভূমিকা : সমাজকর্ম হল একটি বৈজ্ঞানিক জ্ঞানসম্পন্ন পেশাদার সেবাকর্ম, যা মানুষের বহুমুখী সমস্যার প্রতিকার, প্রতিরোধ ও উন্নয়নে কতিপয় পদ্ধতির মাধ্যমে ব্যক্তি, দল ও সমষ্টিকে সহায়তা করে এবং সমাজকর্ম তার সেবাদান প্রক্রিয়ায় শিশুকিশোর, বৃদ্ধ, নারী সব বয়সের মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। যার মধ্য থেকে যুবকরাও বাদ যায় নি।যুবকশ্রেণী হল একটি দেশ ও জাতির চালিকাশক্তি। বাংলাদেশের যুবদের মধ্যে বহুবিধ মনোসামাজিক সমস্যা বিদ্যমান।তাদের সমস্যা সমাধানে সমাজকর্মী নিম্নোক্ত ভূমিকা পালন করতে পারেন।
সমাজকর্মীর ভূমিকা : পেশাদার সমাজকর্মের জ্ঞান ও দক্ষতায় সজ্জিত একজন ব্যক্তি হলেন পেশাদার সমাজকর্মী। যিনি কোন প্রতিষ্ঠানের পেশাদার প্রতিনিধি হিসেবে ব্যক্তি বা দলের জন্য কাজ করেন। এ কাজ করতে গিয়ে তাকে Target group এবং তাদের Problem সম্পর্কে Study (অনুধ্যান) ও গবেষণা করতে হয়। এরপর পরিকল্পনা কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে তিনি সহায়তা করে থাকেন। বাংলাদেশে একজন সমাজকর্মী যুবকদের সমস্যা সমাধানে নিম্নোক্ত সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করতে পারেন :
১. সম্পদের সদ্ব্যবহার : কোন মানুষই একেবারে সম্পদহীন নয়। একটি মানুষের মধ্যে বস্তুগত এবং অবস্তুগত কিছু সম্পদ ও সামর্থ্য থাকে এবং পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রের সদস্য হিসেবে ব্যক্তি কিছু সম্পদ প্রাপ্তির দাবিদার। তাই সমাজকর্মী আমাদের যুব সম্প্রদায়কে তাদের জন্য প্রাপ্ত সম্পদ প্রাপ্তিতে এবং তা তাদের কাজে লাগাতে সহায়তা করতে পারেন, যাতে তারা তাদের সম্পদের সর্বোত্তম সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে।
২. চাহিদা ও প্রয়োজন নির্ধারণে সহায়তা করা : আমাদের দেশের যুব সমাজের একটি বড় অংশই অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত। তারা তাদের নিজেদের চাহিদা ও প্রয়োজন সম্পর্কে যেমন জানে না তেমনি তারা তাদের এসব চাহিদা ও প্রয়োজন সম্পর্কে খুব একটা সচেতনও নয়। ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে তারা তাদের চাহিদা ও প্রয়োজনের কথা তুলে ধরতে পারে না। আমাদের যুবকদের ক্ষেত্রে সমাজকর্মী তাদের প্রয়োজন ও প্রত্যাশা প্রকাশে সহায়তা করতে পারেন।
৩. আত্মনিয়ন্ত্রণে সহায়তা : ব্যক্তির যখন তার নিজস্ব চিন্তাচেতনা ও কর্মকাণ্ডের উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ থাকে তখন উক্ত ব্যক্তিকে একজন আত্মনিয়ন্ত্রিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। আত্মনিয়ন্ত্রণের মূলকথা হল নিজের শক্তি ও সামর্থ্যের দ্বারা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা, চিন্তা ও কর্মে অন্যের উপর নির্ভরশীল না হওয়া। আমাদের দেশে যুবকদের নিজেদের ভবিষ্যৎ কল্যাণে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণে সহায়তা দানে সমাজকর্মী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।
৪. উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে সহায়তা : বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, মানবহিতৈশী দর্শন, পেশাগত দক্ষতা ও মূল্যবোধভিত্তিক একটি সেবাকর্ম হিসেবে সমাজকর্ম মানুষের সমস্যা সমাধানে/মোকাবিলায় কাজ করে চলছে।সমাজকর্মে বিশ্বাস করা হয় যাদের জন্য উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তাদের অংশগ্রহণ অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। কারণ অংশগ্রহণের মাধ্যমে উভয়পক্ষ উভয়পক্ষকে জানতে পারে। ফলে আদানপ্রদান তুলনামূলক সহজ হয়। তাই আমাদের যুবকদের বিভিন্ন ধরনের সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে সমাজকর্মী সহায়তা করতে পারেন।
৫. নেতৃত্বের বিকাশ সাধন : নেতৃত্ব হল ব্যক্তির এমন এক বা একাধিক গুণাবলির সমষ্টি যে গুণাবলি সে স্বীয় অধ্যবসায় বা উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করে এবং এ গুণাবলিসম্পন্ন হওয়ার ফলে সমাজের অন্যান্য ব্যক্তি তাকে মেনে চলে।আমাদের যুব সমাজের মধ্যে আজ নেতৃত্বের খুব অভাব। ফলে তারা সঠিক নির্দেশনা পাচ্ছে না এবং কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে সঠিক পথে এগুতে পারছে না। সুতরাং যুব সমাজের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলির সঞ্চার ও তার বিকাশ সাধনে সমাজকর্মী সাহায্য
দিতে পারেন।
৬. পারিবারিক জীবন শিক্ষা : আমাদের যুব সমাজ পারিবারিক জীবন শিক্ষা সম্পর্কে তেমন একটা জানার সুযোগ পায় না।ফলে দেখা যায় তারা পারিবারিক জীবনে নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়। সুষ্ঠু পরিবার ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থ হয়।পারিবারিক দায়িত্ব যথার্থভাবে পালন করতে পারে না। বাবা-মা হিসেবে তারা নিজেদের উপযুক্ত ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়।সমাজকর্মী আমাদের যুব সমাজকে পারিবারিক জীবন শিক্ষার মাধ্যমে তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে উপযুক্ত বাবা-মা হয়ে গড়ে উঠতে সহায়তা দিতে পারেন।
৭. নৈতিকতাবোধ সৃষ্টি : নৈতিকতাবোধ সৃষ্টি ও তার অনুশীলনে সমাজকর্মী আমাদের দেশের যুবকদের সাহায্য করতে পারেন। কারণ নৈতিক শিক্ষা মানুষের জীবনে অত্যন্ত জরুরি। নৈতিকতার সাথে মানুষের বিবেক ও বিবেচনার গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। এর ফলে যুবকরা সত্য মিথ্যা, উচিৎ অনুচিৎ, ভালোমন্দ চ্যাদি বিচার বিবেচনার সামর্থ্য অর্জনে সক্ষম হবে।
৮. সংশোধনের ক্ষেত্রে সহায়তা : আমাদের দেশে যুবকরা তাদের চাহিদা পূরণ না হওয়ার ফলে নানাবিধ অপরাধ কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। এসব অপরাধীদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশই দেখা যায় অভাবের তাড়নায় জীবনের
প্রয়োজনে অপরাধ কর্মে নিয়োজিত হয়। তাই এদেরকে সংশোধনের মাধ্যমে সমাজে পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে সমাজকর্মী গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম। কারণ সমাজকর্মে মানুষের শাস্তির চেয়ে তাকে সংশোধনের উপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলাদেশে যুবকদের মধ্যে বিদ্যমান বহুবিধ সমস্যা মোকাবিলা/সমাধান করা একটি তুলনামূলক দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া। দীর্ঘদিনের ত্রুটিপূর্ণ এবং দুর্নীতিপূর্ণ জাতীয় পরিকল্পনা ও কর্মসূচির ফলে যুব সমাজ তাদের চাহিদা ও প্রয়োজন পূরণে বরাবরই ব্যর্থ হয়েছে। তবে বলা যায় সমাজকর্ম একই সাথে একটি পেশা এবং একটি মানব দর্শন। আর পেশাদার সমাজকর্মীদের যদি আমাদের দেশের যুব সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে নিয়োজিত করা হয় তবে যুব সমাজের সমস্যা অনেকাংশে দূরীকরণ সম্ভব হবে বলে আমার বিশ্বাস।