বাংলাদেশে নারীদের প্রধান প্রধান সমস্যা সমাধানের উপায় আলোচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশে নারীদের সমস্যা সমাধানের পন্থাগুলো বর্ণনা কর।
অথবা, কী কী উপায়ে বাংলাদেশের নারীদের সমস্যা সমাধান করা যায় বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের নারীদের সমস্যা সমাধানে প্রধান উপায়সমূহ লিখ।
অথবা, বাংলাদেশে নারী সম্পর্কিত সমস্যা সমাধানের উপায় বর্ণনা কর।
উত্তর।। ভূমিকা : একটি সমাজ তথা রাষ্ট্রের মোট জনসমষ্টির প্রায় অর্ধেক হল নারী। যে সমাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীর সমান যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকে ঐ সমাজের অগ্রগতি ও উন্নতি স্বাভাবিকভাবেই বেশি হয়। সমাজে তাই নারীকে গুরুত্ব না দিয়ে নারীর সমস্যার সমাধান না করে শুধুমাত্র পুরুষের সমস্যার উপর গুরুত্ব দিলে সমাজে কখনই ভারসাম্যপূর্ণ এবং সুষম উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই নারীর সমস্যা এবং তা মোকাবিলাকরণের বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় কর্মসূচি ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।
বাংলাদেশে নারীদের সমস্যা সমাধানের উপায় : বাংলাদেশে নারীদের সমস্যা মূলত একটি ঐতিহাসিক/প্রাচীন/ পুরাতন সমস্যা। তবে উক্ত সমস্যা সমাধানের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপসমূহ অনুসরণ করা যেতে পারে। যেমন-
১. দারিদ্র্য দূরীকরণ : আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০% দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। সেখানে নারীদের অবস্থা আরও শোচনীয়। তাই নারীদের দারিদ্র্য দূরীকরণের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ নারীর দারিদ্র্যজনিত সমস্যা আরও অনেক অনেক সমস্যার জন্ম দেয়। দারিদ্র্যের ফলে নারীরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে । সুতরাং নারীদেরকে দারিদ্র্য অবস্থা থেকে মুক্ত করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি উভয় ধরনের উদ্দেশ্য গ্রহণ করতে হবে।
২. ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি : আমাদের দেশের নারীরা সাধারণত গৃহকর্ম সম্পাদন করে থাকে। ফলে দেখা যায় গৃহকর্ম সম্পাদনের পর তাদের হাতে প্রচুর সময় থেকে যায়। পরিবারের এসব গৃহিণী শিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত তরুণী ও যুবতীদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। তাদেরকে তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী বিভিন্ন কর্মে প্রবেশের সুযোগ দিতে হবে। এজন্য তাদের সহজ শর্তে ঋণদানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
৩. নিরক্ষরতা দূরীকরণ : আমাদের দেশের নারীদের নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে হবে। তাদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে হবে। ফলে তারা নিজেকে ও নিজের পরিবেশ সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে শিখবে। তাদের
মধ্যে নির্ভরশীলতা হ্রাস পাবে। অন্যের কুমন্ত্রে সে পরিচালিত না হয়ে নিজে নিজেকে পরিচালিত করতে সক্ষম হবে।এজন্য বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা, যুব শিক্ষাদান কর্মসূচি প্রবর্তন করা যেতে পারে।
৪. স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ : স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। রুগ্ন ও অসুস্থ ব্যক্তি নিজের জন্য এমনকি সমাজের জন্যও বোঝা/সমস্যা। আমাদের নারী শক্তিকে উন্নয়নের পথে ধাবিত করতে হলে তাদের স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তার বিষয়টি অধিক।গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের জন্য যুব স্বাস্থ্য কেন্দ্র অথবা হাসপাতালগুলোতে নারী কর্নার স্থাপন করে তাদের স্বাস্থ্যসেবা দান কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। জাতীয় উৎপাদন ও উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য যুবকদের কাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা প্রদান
একান্ত অপরিহার্য।
৫. পতিতাবৃত্তি রোধ : সকল দেশের সকল সমাজে পতিতাবৃত্তি একটি ঘৃণ্য পেশা। কিন্তু তারপরেও শতশত বছর ধরে সমাজে এ কুপ্রথা টিকে আছে। আমাদের দেশের নারীসমাজকে পতিতাবৃত্তির মত এ অবমাননাকর পেশা থেকে মুক্তি দিতে হবে। এজন্য প্রথমত সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আইন রক্ষাকারী বাহিনীকে এজন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। তাছাড়া এসব পতিতালয়ে কর্মরত পতিতাদেরকে সামাজিকভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
৬. মাদকাসক্তি দূরীকরণ/নিরাময় : মাদকাসক্তিজনিত সমস্যা আমাদের দেশে নারীদের ক্ষেত্রে প্রধানত শহুরে ধনী পরিবার এবং বস্তিতে থাকা দরিদ্র পরিবারগুলোতে তুলনামূলক বেশি দেখা যায়। মাদকের নেতিবাচক প্রভাব পুরুষদের তুলনায় নারীদের উপর বেশি মাত্রায় পরিলক্ষিত হয়। মাদকের প্রভাবে মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থেকে ক্রমশ দূরে সরে যায়, তার শরীরে অবসাদগ্রস্ততা চলে আসে এবং আস্তে আস্তে মৃত্যুর দিকে ঝুঁকে পড়ে। তাই এক্ষেত্রে নারীদের জন্য পারিবারিকভাবে পরিবারের সকল সদস্যকে মাদকের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করা, মাদকের সহজলভ্যতা রোধ করা ইত্যাদি কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে।
৭. নারী নির্যাতন রোধ : আমাদের দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য নারী নির্যাতন রোধ করতে হবে। যেসব পরিবারে নারী নির্যাতনের হার বেশি ঐসব পরিবারের সন্তানরা হতাশা, উদ্বিগ্নতা ও হীনম্মন্যতায় ভোগে। আবার দেখা যায়, মা-বাবার মধ্যে ঝগড়াঝাটি, মারামারির ফলে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং অপরাধকর্মে জড়িয়ে পড়ে। সুতরাং নারী নির্যাতন রোধের জন্য সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে, যৌতুকের মত কুপ্রথাকে পরিহার করতে হবে।
৮. সুষ্ঠু সামাজিকীকরণ : আমাদের দেশে অপরাধীদেরকে যথাযথভাবে সামাজিকীকরণ করতে হবে। এজন্য জন্মের পর থেকে পরিবার তাদের সামাজিকীকরণে সহায়তা প্রদান করবে। নারীদেরকে সামাজিক রীতিনীতি, প্রথাপ্রতিষ্ঠান, আদর্শ মূল্যবোধ ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন করে তুলতে হবে। প্রয়োজনে তাদেরকে প্রচলিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের ভাবধারা থেকে সরিয়ে উন্নত ও আধুনিক সমাজের ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলাদেশে নারীদের সমস্যা একটি ঐতিহাসিক/প্রাচীন সমস্যা, যে সমস্যার সূত্রপাত একদিনে হয় নি। পুরুষ শাসিত এদেশের সমাজব্যবস্থায় তাই দেখা যায় নারীর চাহিদা ও প্রয়োজন যুগে যুগে উপেক্ষিত ও অপূরণীয় থেকে গেছে।