মৌল মানবিক চাহিদা বলতে কী বুঝ? মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে সমাজকর্মীর ভূমিকা আলোচনা কর।

অথবা, মৌল মানবিক চাহিদা কাকে বলে? সমাজকর্মী মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে কি কি ভূমিকা রাখতে পারে তা আলোচনা কর।
অথবা, মৌল মানবিক চাহিদার সংজ্ঞা দাও। এটা পূরণে সমাজকর্মীর ভূমিকা কী হওয়া উচিত বলে মনে কর?
অথবা, মৌল মানবিক চাহিদা ধারণাটি ব্যাখ্যা কর। মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে একজন দক্ষ সমাজকর্মীর ভূমিকা কী হতে পারে?
অথবা, মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে সমাজকর্মীর ভূমিকা উল্লেখ পূর্বক এর সংজ্ঞা নিরূপণ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। আবার মানুষ সামাজিক জীবও বটে। তাই জীবনধারণ, বংশবিস্তার ও সমাজে সভ্য মানুষ হিসেবে বসবাস করতে গেলে মানুষকে নানাবিধ চাহিদা পূরণ করতে হয়। এসব চাহিদা পূরণ ছাড়া মানুষ সমাজে সভ্য মানুষ হিসেবে বাঁচতে পারে না। এ ধরনের অত্যাবশ্যকীয় চাহিদাসমূহকেই মৌল মানবিক চাহিদা বলে। সমাজকর্ম এমন একটি পেশা যা তার জ্ঞান ও দক্ষতা দিয়ে সমাজের মানুষের সব ধরনের সমস্যা সমাধান করে থাকে। সমাজ কর্মের শিক্ষায় শিক্ষিতরাই সমাজকর্মী। সমাজকর্মীদের সমস্যা সমাধানের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞান
রয়েছে। তাই বাংলাদেশের মৌল মানবিক চাহিদা পূরণেও সমাজ কর্মীরা ভূমিকা রাখতে পারে।
মৌল মানবিক চাহিদা : আগেই বলা হয়েছে মানুষের জীবনধারণ ও সামাজিকতা রক্ষার জন্য যেসব প্রয়োজন তা পূরণ করা অত্যাবশ্যক তাকে মৌল মানবিক চাহিদা বলে। এ চাহিদাগুলো এতটাই প্রয়োজনীয় যে, এগুলোর অভাবে
মানুষ বাঁচতে পারে না। যেমন- খাদ্যের অভাবে মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : মৌল মানবিক চাহিদা সম্পর্কে বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তাঁদের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা প্রদান করা হল :
অধ্যাপক ড. মোঃ নূরুল ইসলাম মৌল মানবিক চাহিদা সম্পর্কে বলেছেন, “Which needs are essential for human life are call Basic human need.” অর্থাৎ, মানুষের জন্য যেসব জিনিস অত্যন্ত প্রয়োজনীয় তাকে মৌল
মানবিক চাহিদা বলে।
ডেভিড জেরী ও জুলিয়া জেরী কলিঙ্গ সমাজবিজ্ঞান অভিধান সম্পাদনা করেন। উক্ত অভিধানে তাঁরা বলেছেন, “Basic human needs the conception that all human beings sure fundamental needs by virtue of their humanity. The fulfillment of these full participation in social life.” অর্থাৎ, মৌল মানবিক চাহিদা হল একটি ধারণা, যেখানে মানুষ সকল মানবিকতার কারণে মৌলিক চাহিদায় অংশগ্রহণ করে। সমাজজীবনে পূর্ণ অংশগ্রহণের মাধ্যমে মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ হয়।
উপরের আলোচনা থেকে একথা বলা যায় যে, মৌল মানবিক প্রয়োজন হল সেসব প্রয়োজনের সমষ্টি যা মানুষের জীবনধারণ ও সামাজিকতা রক্ষার জন্য অত্যাবশ্যক। এগুলো পূরণ না হলে মানুষ বাঁচতে পারে না ও সামাজিকতা রক্ষা
করতে পারে না।
মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে সমাজকর্মীর ভূমিকা : সমাজকর্মের শিক্ষায় শিক্ষিতরাই সমাজকর্মী।সমাজকর্মীদের সব ধরনের সমস্যা সমাধানের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞান রয়েছে। বাংলাদেশে মৌল মানবিক চাহিদা কেন সঠিকভাবে পূরণ হচ্ছে না তার কারণ অনুসন্ধান করে নিম্নোক্ত উপায়ে সমাজকর্মীর মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখতে পারে :
১. তথ্য সংগ্রহ : বাংলাদেশে মৌল মানবিক চাহিদা সঠিকভাবে পূরণ হচ্ছে না। কতটুকু পূরণ হচ্ছে কতটুকু হচ্ছে না তার সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে পারে সমাজকর্মীরা। তাছাড়া সমাজের কোন অংশের মানুষ কতটুকু চহিদা পূরণ করছে তার তথ্য যারা পূরণ করছে না তারা কেন পারছে না ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে সমাজকর্মীরা।
২. তথ্য বিশ্লেষণ : সমাজকর্মীরা বাংলাদেশে মৌল মানবিক চাহিদা কেন পূরণ হচ্ছে না তার উপর জরিপ করে যে তথ্য সংগ্রহ করল তা যাচাইবাছাই করে বিশ্লেষণ করতে পারে। বিশ্লেষিত তথ্য থেকে সহজেই জানা যায় কেন চাহিদাগুলো পূরণ হচ্ছে না।
৩. সমস্যা নির্ণয় : তথ্য সংগ্রহ করে, বিশ্লেষণের মাধ্যমে সহজেই পাওয়া যাবে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের অন্তরায়গুলো। অন্তরায়গুলো দূরীকরণের মাধ্যমে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে সমাজকর্মীরা সহায়তা করতে পারে।
৪. গবেষণা : সমাজকর্মীরা মৌল মানবিক চাহিদাগুলো পূরণ না হওয়ার ফলে সৃষ্ট সমস্যাবলি ও তার সমাধানের জন্য প্রয়োজনে গবেষণা চালাতে পারে। গবেষণার মাধ্যমে সঠিক সমাধান আশা করা যায়।
৫. সচেতনতা বৃদ্ধি : গবেষণার মাধ্যমে প্রাপ্ত সমস্যার কারণগুলো সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তুলতে পারে সজকর্মীরা। যে যে কারণে চাহিদাগুলো পূরণ হচ্ছে না তা যেন আর না ঘটে সে ব্যাপারে জনগণকে সচেতন করলে ঐ
সমস্যার সমাধান হবে সহজেই।
৬. জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ : বাংলাদেশে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের অন্যতম বাধা হল জনসংখার বৃদ্ধি। তাই জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধে সমাজকর্মীরা ভূমিকা রাখতে পারে। তারা জনগণকে জনসংখ্যা সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে পারে।জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে পারে । এছাড়া জনসংখ্যা বৃদ্ধির সুফল সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তুলতে পারে।
৭. স্বাস্থ্য সচেতন করে তোলা : সমাজকর্মীরা জনগণকে স্বাস্থ্য সচেতন করে তুলতে পারে। স্বাস্থ্য কিভাবে ঠিক রাখ যায়, কিভাবে পুষ্টিমান বজায় রাখা যায়, প্রাথমিক চিকিৎসা ও রোগব্যাধি সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তুলতে পারে।
৮. কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা : বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের মারাত্মক অভাব রয়েছে। কর্মসংস্থানের অভাবে জনগণ মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। তাই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কর্মসংস্থান ও গ্রামীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে জনগণকে সহায়তা করতে পারে সমাজকর্মীরা।
৯. বাসস্থানের সমস্যা সমাধানের সহায়তা : বাংলাদেশের বাসস্থানের সমস্যা অত্যন্ত প্রকট। সমাজকর্মীরা বাসস্থানের সমস্যা সমাধানে জনগণকে সহায়তা করতে পারে। কিভাবে ভালো বাসস্থান নির্মাণ করা যায়, বাসস্থানের জায়গা নির্বাচন ও লোনের ব্যবস্থা করতে পারে সমাজকর্মীরা।
১০. নারী কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা : বাংলাদেশে অধিক জনসংখ্যা নারী হলেও তারা উৎপাদনের সাথে জড়িত নয়। তাই বাংলাদেশের বিপুল নারী জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে সমাজকর্মীরা। ফলে আয় বাড়বে।আর আয় বাড়লে মৌল মানবিক চাহিদাগুলোও সঠিকভাবে পূরণ করা যাবে।
১১. খাদ্য সমস্যা সমাধান : সমাজকর্মীরা খাদ্য সমস্যা সমাধানের জন্য কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দিতে পারে।কিভাবে উন্নত বীজ ও সারের ব্যবহার করতে হয়, পানিসেচ কখন দিতে হবে ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দিতে পারে।প্রয়োজনে কৃষকদের জন্য কৃষি ঋণেরও ব্যবস্থা করতে পারে সমাজকর্মীরা।
১২. শিক্ষার প্রসার : সমাজকর্মীরা অজ্ঞ ও নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করে তুলতে পারে।তাছাড়া শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও সুফল সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তুলতে পারে। এছাড়াও শিক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহের মাধ্যমেও মানুষকে শিক্ষিত করে তুলতে পারে সমাজকর্মীরা।
১৩. চিত্তবিনোদনের চাহিদা : সমাজকর্মীরা জনগণকে সুষ্ঠু চিত্তবিনোদনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে পারে। এছাড়াও কিভাবে পারিবারিক পরিবেশে বিনোদন করা যায় তার উপর সচেতন করে তুলতে পারে।
১৪. যুব কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা : সমাজকর্মীরা যুবকদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে যুব কর্মসংস্থানের ব্যবস্থ করতে পারে। হাঁস মুরগী পালন, মৎস্য চাষ, গবাদি পশু পালন ইত্যাদি বিষয়ে যুবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আত্মনির্ভরশীল করে তুলতে পারে।ফলে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে তারা ভূমিকা রাখতে পারবে।
১৫. নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়তা : সমাজকর্মীরা সরকারকে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের জন্য যুগোপযোগী নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণে সহায়তা করতে পারে। কারণ সমাজকর্মীরা সংগৃহীত তথ্যের মাধ্যমে নীতি ও পরিকল্পনা কি কি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে তা ঠিক করবে। ফলে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণ হবে।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা হতে একথা বলা যায় যে, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ বলে নানারকম প্রাকৃতিক ও সামাজিক সমস্যা বিদ্যমান। এসব সমস্যার কারণে এদেশে মৌল মানবিক চাহিদা সঠিকভাবে পূরণ হচ্ছে না।তবে একথাও ঠিক এসব সমস্যা সমাধানের অযোগ্য নয়। সমাজকর্মীরাও তাদের জ্ঞান, যোগ্যতা, দক্ষতা ও নৈপূণ্যতা এবং তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞানের সফল প্রয়োগের মাধ্যমে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখতে পারে।