অথবা, বাংলাদেশে বর্তমানে মৌল মানবিক চাহিদা কি পূরণ হচ্ছে, না হচ্ছে না বিস্তারিত আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশে বর্তমানে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের বর্তমান অবস্থা বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশে বর্তমানে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণ হচ্ছে কী? তোমার যুক্তি দাও।
উত্তর৷ ভূমিকা : মানুষ সামাজিক জীব। তাই জীবনধারণের জন্য মানুষকে খাদ্য গ্রহণ করতে হয়। আবার সামাজিকতা রক্ষার জন্যও কিছু কিছু জিনিস মানুষের অত্যাবশ্যকীয়। সুতরাং যেসব বস্তু মানুষের জীবনধারণ ও সামাজিকতা রক্ষার জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় বা যা ছাড়া মানুষ সমাজে মানুষ হিসেবে বাঁচতে পারে না তাকে মৌল মানবিক চাহিদা বলে। বাংলাদেশ দরিদ্র ও অতিরিক্ত জনসংখ্যার দেশ। একদিকে সীমিত সম্পদ, অন্যদিকে বিপুল জনসংখ্যা। তাই
মৌল মানবিক প্রয়োজন পূরণে বাংলাদেশকে হিমশিম খেতে হয়।
বাংলাদেশে মৌল মানবিক প্রয়োজন সঠিকভাবে পূরণ হচ্ছে কি না : বাংলাদেশ সীমিত সম্পদের দেশ। কিন্তু এর বিপুল জনসংখ্যা মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে বাধার সৃষ্টি করছে। তাই বাংলাদেশে বর্তমানে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করে আমরা দেখব মৌল মানবিক চাহিদাগুলো সঠিকভাবে পূরণ হচ্ছে কি না :
১. খাদ্য (Food) : খাদ্য প্রধান ও প্রথম মৌল মানবিক চাহিদা। কিন্তু বাংলাদেশে প্রতিবছরই খাদ্যঘাটতি হয়।কারণ এত ছোট দেশের পক্ষে বিপুল জনসংখ্যার খাদ্য উৎপাদন সম্ভব নয়। তাই প্রতিবছরই বাং শে ১৫-২০ লক্ষ মেঃ টঃ খাদ্যঘাটতি হয়। তাছাড়া কৃষিজমি দ্রুত হ্রাস পাওয়ার ফলে খাদ্যঘাটতি আরও তীব্রতর হচ্ছে। এছাড়াও নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসল নষ্ট হলে খাদ্যঘাটতি আরও বেশি হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, গড়ে একজন মানুষের মাথাপিছু ১.২ একর থেকে ১.৮ একর জমি দরকার। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমানে গড়ে মাথাপিছু আবাদি জমির পরিমাণ .১৩ একর।অনুন্নত প্রযুক্তি এবং সার ও বীজের অভাবের ফলে বাংলাদেশের উৎপাদন ক্ষমতা কম। যেমন- ইন্দোনেশিয়ায় প্রতি একরে ৪০ মণ ধান উৎপাদিত হলেও বাংলাদেশে হয় মাত্র ১৪ মণ। অন্যদিকে, ইতালি ও জাপানে একর প্রতি ধান উৎপাদিত হয় যথাক্রমে সাড়ে ৫৫ মণ ও সাড়ে ৪২ মণ।
২. বস্ত্ৰ (Cloth) : মৌল মানবিক চাহিদা হিসেবে খাদ্যের পরেই বস্ত্রের স্থান। কিন্তু বাংলাদেশে বস্তুচাহিদা সঠিকভাবে পূরণ হচ্ছে না। কারণ বাংলাদেশে চাহিদার তুলনায় বস্ত্র উৎপাদন খুবই কম। পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, বছরে প্রতিটি মানুষের ১০ মিটার বস্ত্রের প্রয়োজন। সুতরাং বছরে সারাদেশে ৩১২ কোটি মিটার বস্ত্রের প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে বস্ত্র উৎপাদন হয় মাত্র ৯৭ কোটি মিটার। ফলে প্রতিবছর ২১৫ কোটি মিটার বস্ত্রের ঘাটতি হয়, যা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।
৩. বাসস্থান (Shelter) : মৌল মানবিক চাহিদা হিসেবে বস্ত্রের পরেই বাসস্থানের স্থান। বাসস্থান ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশে বাসস্থান সমস্যা অত্যন্ত প্রকট।প্রতিবছর নতুন জনসংখ্যার জন্য অতিরিক্ত ২২ লক্ষ গৃহের প্রয়োজন। যে প্রয়োজন মিটানোর জন্য জমি ও অন্যান্য উপকরণ নেই। শহর অঞ্চলে বাসস্থান সমস্যা আরও প্রকট।বাসস্থানের অভাবে হাজার হাজার মানুষ বস্তিতে বাস করে। শুধু ঢাকা শহরেই ২৫০০ বস্তি রয়েছে। শহরের এক-তৃতীয়াংশ ও গ্রামের এক-চতুর্থাংশের নিজস্ব বাসস্থান নেই। এছাড়া বাংলাদেশে প্রতিটি ঘরে গড়ে ছয়জনেরও বেশি বাস করে, যা মোটেও স্বাস্থ্যসম্মত নয়। বাসস্থানের অভাবে খোলা আকাশের নিচে অনেক লোক বাস করে। সুতরাং বাসস্থানের চাহিদাও
বাংলাদেশে সঠিকভাবে পূরণ হচ্ছে না।
৪. শিক্ষা (Education) : শিক্ষা অন্যতম মৌল মানবিক চাহিদা। কারণ শিক্ষা ছাড়া মানুষ উন্নতি করতে পারে না।বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষিতের হার ৬৫% বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে এর সংখ্যা আরও কম। ১৯৯৩ সালের হিসাব মতে,বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৪৯,৯৪২টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১,০৯৫টি, মাদ্রাসার সংখ্যা ৬,১৭৯টি এবং সাধারণ কলেজ ৯৮৯টি; বর্তমানে সরকারি মেডিকেল কলেজ ১৩টি, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ২২টি, ডেন্টাল কলেজ ২টি, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ৫টি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ৮টি, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১৭টি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৫৩টি, যা জনসংখ্যার তুলনায় খুবই কম। তবে আসল কথা হল সরকার সম্প্রতি কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এবং শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দিয়ে যাচ্ছে। তার পরেও বাংলাদেশে শিক্ষার মত মৌল মানবিক চাহিদা সঠিকভাবে পূরণ হচ্ছে না।
৫. স্বাস্থ্য (Health) : স্বাস্থ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ মৌল মানবিক চাহিদা। কিন্তু বাংলাদেশে স্বাস্থ্য চাহিদা পূরণের চিত্র একেবারে হতাশাব্যঞ্জক। বাংলাদেশের অনেক জনগণ পুষ্টিহীনতা ও স্বাস্থ্যহীনতায় ভুগছে। এছাড়াও জনসংখ্যার তুলনায় ডাক্তার, নার্স ও চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব রয়েছে। তাছাড়া ডাক্তারদের অবহেলা, ঠিকমতো রোগী না দেখা, ক্লিনিকে বাণিজ্য ইত্যাদি কারণে মানুষ স্বাস্থ্যসেবা হতে বঞ্চিত হচ্ছে। উচ্চতর স্বাস্থ্যসেবা সাধারণ জনগণের নাগালের বাইরে চলে গেছে। তাছাড়া যন্ত্রপাতি, ঔষধপত্র ইত্যাদির অভাব তো রয়েছেই। তাই এ কথা বলা যায় যে, ১৪ কোটি লোক স্বাস্থ্যসেবা হতে সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হচ্ছে।
৬. চিত্তবিনোদন (Recreation) : চিত্তবিনোদন মানুষের অন্যতম মৌল মানবিক প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে চিত্তবিনোদন পূরণের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। কারণ বাংলাদেশে খেলাধুলা, পার্ক ইত্যাদির অভাব রয়েছে। তাছাড়া দরিদ্রতার কারণে মানুষ এগুলোর প্রতি আগ্রহ দেখায় না। এদেশের অশ্লীল চলচ্চিত্র মানুষের বিনোদন মিটাতে ব্যর্থ হচ্ছে।ফলে মানুষ বিনোদনের অভাবে নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশ অনুন্নত ও দরিদ্র দেশ। কিন্তু এদেশের জনসংখ্যার তুলনায় সম্পদের পরিমাণ অত্যন্ত সীমিত। এছাড়া উপযুক্ত পরিকল্পনা ও কর্মসূচির অভাবে বাংলাদেশে মৌল মানবিক চাহিদা সঠিকভাবে পূরণ হচ্ছে না। কিন্তু মৌল মানবিক চাহিদা সঠিকভাবে পূরণ হওয়া একান্ত প্রয়োজন।মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে যেসব বাধা আছে তা দূরীকরণের মাধ্যমে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণ করতে হবে, তবেই জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত হবে।