অথবা, শিশুর চাহিদা কাকে বলে? শিশুর চাহিদা পূরণ না হলে যে সকল সমস্যা সৃষ্টি হয় সেগুলো বর্ণনা কর।
অথবা, শিশুর চাহিদার সংজ্ঞা দাও। শিশুর চাহিদা পূরণ না হলে কী কী সমস্যার আশঙ্কা থাকে তা বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : একটি দেশ তথা জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার হল শিশু। কারণ আজকের শিশুই আগামী দিনের দেশ ও জাতির পরিচালক ও নিয়ন্ত্রক। তাই বর্তমান বিশ্বে শিশুর চাহিদা পূরণের জন্য এখন বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোও শিশুদের চাহিদা পূরণের দিকে আস্তে আস্তে সচেতন হচ্ছে এবং সে লক্ষ্যে তারা বিভিন্ন কর্মসূচি প্রবর্তন ও বাস্তবায়ন করছে। পেশাদার সমাজকর্মেও শিশু কল্যাণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তাই সমাজকর্মের ছাত্র হিসেবে শিশুদের চাহিদা, চাহিদা অপূরণজনিত উদ্বুদ্ধ সমস্যাগুলো আমাদের জানা দরকার।
শিশু : শিশুর চাহিদা জানতে হলে আগে আমাদের জানতে হবে শিশু কারা। সাধারণ অর্থে জন্ম থেকে শুরু করে যৌবন আসার পূর্ববর্তী বয়সের অধিকারীদেরকেই শিশু বলা যেতে পারে।
জাতিসংঘের মতে, “১৮ বছরের নিচে সব মানব সন্তানকে শিশু বলা হবে, যদি না শিশুর জন্য প্রযোজ্য আইনের আওতায় ১৮ বছরের আগেও শিশুকে সাবালক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।”
বাংলাদেশ করখাতের জাতীয় শিশু নীতি (১৯৯৪) অনুযায়ী ১৪ বছরের কম বয়সি ছেলেমেয়েদের শিশু বলে অভিহিত করা হয়।
শিশুর বা শিশুদের চাহিদা : শিশুদের চাহিদা আসলে একটি মানব সন্তানের জন্মের পর থেকে অনুভূত হয় না। শিশুর চাহিদা ব্যাপক অর্থে তার জন্মপূর্ব সময় থেকেই বিবেচ্য। তাই শিশুর চাহিদার সংজ্ঞায় বলা যায়, মাতৃগর্ভ থেকে শুরু করে যৌবন প্রাপ্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মানব সন্তানের মধ্যে তার মনোদৈহিক,সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ সাধনের জন্য যেসব উপাদান বা প্রয়োজনসমূহ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং যা ছাড়া শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশ ব্যাহত হয় সেসব উপাদানকে বা প্রয়োজনকে শিশুর চাহিদা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায়। সাধারণত শিশুর চাহিদা পাঁচ রকমের হয়ে থাকে।
যথা : ১. দৈহিক চাহিদা,
২. মানসিক চাহিদা,
৩. শিক্ষার চাহিদা,
৪. সুস্বাস্থ্য লাভের চাহিদা এবং
৫. সাংস্কৃতিক চাহিদা।
শিশুর চাহিদা অপূরণজনিত সমস্যা : শিশুর চাহিদার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, শিশুর চাহিদা পূরণ করা শিশুর সার্বিক বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য অপরিহার্য। অর্থাৎ শিশুর চাহিদা পূরণ না হলে শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশ ব্যাহত হবে। শিশুর চাহিদা পূরণ না হওয়ার ফলে যেসব সমস্যা বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় তা নিম্নে পর্যায়ক্রমে উপস্থাপন করা হল :
১. প্রতিবন্ধী শিশু : যেহেতু শিশুর চাহিদা তার মাতৃগর্ভ থেকে শুরু হয় তাই মায়ের পেটে থাকাকালীন মা যদি যথাযথ পরিচর্যা না পায় তবে তা শিশুকে প্রভাবিত করে। মা যদি কোন ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেন, নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করেন, অতিরিক্ত ঔষধ গ্রহণ করেন তবে ঐ মা অনেক সময়ই প্রতিবন্ধী শিশু জন্ম দিয়ে থাকেন।
২. পুষ্টিহীনতা : মানুষের দেহে ছয়টি খাদ্য উপাদান যখন সঠিক মাত্রায় না থাকে অর্থাৎ কোন কোন উপাদানের ঘাটতি থাকে তখন সে অবস্থাকে পুষ্টিহীনতা বলে। আমাদের দেশে প্রায় ৭০% শিশু পুষ্টিহীনতার শিকার। কারণ দেখা যায়, আমাদের অধিকাংশ জনসাধারণই দরিদ্র। ফলে তাদের পক্ষে তাদের শিশুদের জন্য পুষ্টিকর খাবার প্রদান করা সম্ভব হয় না। ফলে এসব শিশুরা ব্যাপকহারে পুষ্টিহীনতার শিকার হয়।
৩. রোগগ্রস্ততা বা রোগাক্রান্ত : শিশুদের মৌলিক চাহিদা হল উপযুক্ত স্বাস্থ্য সেবা। যদি শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা করা না যায় তবে তারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। এসব রোগব্যাধি শিশুদেরকে অনেক সময় শারীরিক ও মানসিকভাবে পঙ্গু করে দেয়, যা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের উপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। ফলে তারা দেশ ও জাতির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
৪. শিক্ষালাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত : শিশুদের অন্যতম একটি চাহিদা হল শিক্ষা। শিক্ষা শিশুকে তার জ্ঞানচক্ষু বিকশিত হতে সহায়তা করে। শিক্ষা প্রত্যেকটি শিশুর একটি চাহিদা হিসেবে সমগ্র বিশ্বে স্বীকৃত। শিশু যদি তার এ প্রয়োজনটি পূরণ করতে না পারে তবে সে অশিক্ষিত নাগরিক হিসেবে বেড়ে উঠে। তার মধ্যে মনো-সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হয়।
৫. নিরাপত্তাহীনতা : শিশুরা হল সমাজের সবচেয়ে অক্ষম ও অসহায় শ্রেণী। তাদের চাহিদা তাদের নিজেদের দ্বারা পূরণ করা আদৌ সম্ভব নয়। এজন্য তাদেরকে তাদের মা-বাবা, পরিবার তথা সমাজের উপর নির্ভর করতে হয়। শিশুদের চাহিদা যদি যথাযথভাবে পূরণ না হয় তবে তাদের স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠা এমনকি বেঁচে থাকার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়।
৬. শিশু নির্যাতন : নির্যাতন হল একধরনের আঘাত বা ক্ষতি। শিশুরা অনেক সময় দেখা যায় নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়। তাদেরকে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত করা হয়। এসব ক্ষেত্রে তাদের পারিশ্রমিক তো দেওয়া হয়ই না, তার উপরে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। অকথ্য ভাষায় তাদের গালিগালাজ করা হয়।
৭. শিশু অপরাধ : সমাজকর্তৃক অসমর্থিত অথচ শিশু বয়সীদের দ্বারা সংঘটিত কর্মকাণ্ডই সমাজে শিশু অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়।শিশুদের চাহিদা পূরণ না হওয়ার ফলে তারা অপরাধমূলক কাজে প্রবৃত্ত হয়। যেমন- কোন শিশু যদি সে নিয়মিত খাবার না পায় তবে সে ক্ষুধার তাড়নায় খাবার চুরি করতে বাধ্য হয়। আস্তে আস্তে চুরি বিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জন করে।
৮. বেপরোয়া ও বিশৃঙ্খল জীবনযাপন : শিশুদের যখন মৌলিক চাহিদা সঠিকভাবে পূরণ করা হয় তখন তারা স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে অনেকটা বাইরে চলে যায়। অপ্রাপ্তি এবং অবহেলা তাদের জীবনকে এলোমেলো করে দেয়।তারা বেড়ে ওঠে শৃঙ্খলহীনতার মধ্যে। তারা হয়ে উঠে বেপরোয়া। তাদের মধ্যে আনুগত্যের প্রবণতা (ঙনবফরবহঃ) হ্রাস পায়।
৯. নৈতিকতার অবক্ষয় : ভালোমন্দ, সঠিক বেঠিক ইত্যাদি উপলব্ধি করা এবং ইতিবাচক বিষয়টি গ্রহণ করার মধ্য দিয়েই নৈতিকতার প্রকাশ পায়। যে শিশু সত্য মিথ্যা, ভালোমন্দ সম্পর্কে শিক্ষা পায় না, যে আদর, স্নেহ, মমতা বঞ্চিত পরিবেশে বেড়ে উঠে তার মধ্যে নৈতিকতা অবক্ষয় দেখা দেয়। সত্য মিথ্যা,ভালোমন্দ এসবের কোন অনুভূতি তার মধ্যে দেখা যায় না।
১০. সামাজিকীকরণের অভাব : সামাজিকীকরণ একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। পরিবার থেকে শিশুর এ সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু যে পরিবারে শিশুর চাহিদা পূরণ হয় না যথাযথভাবে সে পরিবারের শিশুর সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় মারাত্মকভাবে। ফলে শিশু সমাজের উপযোগী আচরণ প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয়।সামাজিকভাবে নিজেকে খাপখাওয়াতে ব্যর্থ হয়।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, শিশুদের চাহিদার বিষয়টি সবাইকে সব প্রয়োজন ও চাহিদার আগে স্থান দিতে হবে। কারণ দেশের ভবিষ্যৎ উন্নতি ও সমৃদ্ধির দায়িত্ব এক সময় এ শিশুদের হাতেই বর্তাবে।আর যদি চাহিদা পূরণের মধ্য দিয়ে তারা স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠে তবেই তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে সক্ষম হবে। তাই শিশুদের চাহিদা পূরণের জন্য পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রকে আরও সচেতনভাবে এবং কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।