অথবা, কেন্দ্রীয় সরকারের কীভাবে স্থানীয় সরকার নিয়ন্ত্রণ করে? বর্ণনা কর।
অথবা, স্থানীয় সরকারের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : আধুনিককালের প্রশাসনিক ব্যবস্থা পর্যালোচনা করলে একটি বিষয় সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। দিন দিন স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়ে চলছে। পূর্বে কোনো রাজা বা মহারানি সমগ্র দেশকে একটি কেন্দ্রীয় প্রশাসনযন্ত্রের সাহায্যে যথেষ্ট প্রতাপের সাথে শাসন করতো। তখন দেশের কেন্দ্রীয় সরকারই ছিল সকল ক্ষমতার মূল উৎস। এমনকি গণতান্ত্রিক দেশেই বিকেন্দ্রীকরণ নীতি গৃহীত হয়েছে। তাই আঞ্চলিক বা স্থানীয় সমস্যা স্থায়ীভাবে
সমাধানকল্পে স্থানীয় সংস্থাসমূহকে যথেষ্ট স্বাধীনতা প্রদান করা হয়েছে। অনেক দেশের সংবিধানে এ স্বায়ত্তশাসনের অধিকার স্বীকৃতি পেয়েছে। দেশের ভৌগোলিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে স্থানীয় সরকারের গুরুত্ব এবং তাৎপর্য দিন দিন বেড়ে চলেছে।
স্থানীয় সরকারের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ : স্থানীয় সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যকার সম্পর্ক কেমন হবে বা কেন্দ্রীয় সরকার স্থানীয় সরকারের উপর কতটুকু নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এগুলো বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম হতে পারে। তাছাড়া, নিয়ন্ত্রণের প্রকৃতিও বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। স্থানীয় সরকারের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের যেসব নিয়ন্ত্রণ পরিলক্ষিত হয় তা নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. বিচার বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণ : স্থানীয় সরকারের উপর বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া।
স্থানীয় সরকারের আইনকে দু’ভাগে ভাগ করা যায় :
প্রথমত, স্থানীয় সরকারের সাধারণ আইনের কতকগুলো শাখা রয়েছে সেখানে বিশেষ নিয়ম প্রয়োগ করা হয়। সাধারণভাবে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তার নিজের কাজের জন্য দায়ী থাকে।
দ্বিতীয়ত, স্থানীয় সরকার তার কার্যাবলি কিভাবে বাস্তবে রূপায়িত করবে তার সাথে সম্পর্কিত কিছু আইন রয়েছে। তাছাড়া, স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে কতকগুলো আচার আচরণ সংক্রান্ত নিয়মাবলি মেনে চলতে হয়। যেমন- স্বাভাবিক ন্যায়বিচার নীতি । তবে এসব নিয়মাবলির মধ্যে দুটি উল্লেখযোগ্য।
প্রথমত, কোনো মানুষই তার নিজের জন্য বিচার করতে পারবে না।
দ্বিতীয়ত, কোনো ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করার পূর্বে তার শুনানি গ্রহণ করতে হবে। তবে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের উপর বিচার বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণের সর্বশেষ হাতিয়ারটি হলো রিট আবেদন।
২. প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ : সরকারের বিভাগসমূহ স্থানীয় কর্তৃপক্ষের যাবতীয় কার্যাবলি পরিদর্শন করে থাকে। পরিদর্শন কাজের আবার দু’টি দিক রয়েছে। প্রথমত, স্থানীয় কাজ দক্ষতার সাথে পরিচালিত হচ্ছে কি না এবং এর মান বজায় রাখা হচ্ছে কি না তা দেখা হয় এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কৌশল, ও নীতি উন্নয়নের জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়।
দ্বিতীয়ত, তাকে আপত্তি শুনতে হয় এবং মন্ত্রিবৃন্দের নিকট রিপোর্ট করতে হয়। এ পরিদর্শন পদ্ধতি সভার নীতি নিয়ে
তেমন ব্যস্ত থাকে না, বরং সভার কর্মচারীরা তাদের কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করে কি না সে দিকে দৃষ্টি রাখে।
৩. অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ : সাধারণত বলা হয় যে, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ স্থানীয় পর্যায়ে প্রাপ্ত সম্পদের দ্বারাই তাদের যাবতীয় অর্থনৈতিক প্রয়োজন ও কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনৈতিক সাহায্য বা বরাদ্দ নিয়েই চলতে হয়। ফলে এ সাহায্য কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক স্থানীয় সরকারকে নিয়ন্ত্রণের
সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। কেননা, কোনো ঋণ লাভের পূর্বে স্থানীয় সরকারকে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন গ্রহণ করতে হয়। স্থানীয় সরকারের এ হিসাব সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হিসাবরক্ষক দ্বারা পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। আয়ব্যয়ের অনুমোদনের মাধ্যমে সংসদ প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং এটি একটি কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ করে।
৪. সংসদীয় নিয়ন্ত্রণ : স্থানীয় সরকার সৃষ্টি হয়েছে আইনের মাধ্যমে। তাই সাধারণভাবেই এটা নির্দেশিত হয় যে, কেন্দ্রীয় সরকারের লিখিত আইনের বাইরে স্থানীয় সরকারের কোনো ক্ষমতাই নেই। যদি কোনো পরিষদ তার ক্ষমতা অতিক্রম করে তবে বিচার বিভাগ এর কার্যাবলির মোকাবিলা করে এবং সেখানে আইনের বাইরে ক্ষমতা ভোগ ও প্রয়োগের
কারণ দর্শানোর নির্দেশ এবং অতিরিক্ত কার্যাবলিকে বাতিল বলে ঘোষণা করে। সুতরাং, স্থানীয় পরিষদ কেবল কেন্দ্রীয় আইন
পরিষদ প্রণীত শাসনতান্ত্রিক নীতিকেই বাস্তবায়ন করে। তাছাড়া, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের আইন সংক্রান্ত কার্যাবলিও খুবই সীমিত।
একমাত্র স্থানীয় বিষয়াদির উপর আইন তৈরি ছাড়া এ কর্তৃপক্ষের আইন সংক্রান্ত আর কোনো ক্ষমতা নেই বললেই চলে এবং
এখানেও তাদের যাবতীয় সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণরূপে কেন্দ্রীয় সরকারের পর্যবেক্ষণ ও অনুমোদনের আওতাধীন। মোটকথা, স্থানী সরকারের কাঠামো, গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলি সবকিছুই জাতীয় আইন পরিষদ বা সংসদ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, যে কোনো দেশের ভৌগোলিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে বিশ্বজুড়ে স্থানীয় সরকার ও প্রশাসন ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেন্দ্রীয় সরকার আছে বলেই স্থানীয় সরকারের সৃষ্টি।
সুতরাং, কেন্দ্রীয় সরকার স্থানীয় সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে মাত্রাতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণই স্থানীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যাপারে ভালো নয়। এতে স্থানীয় সরকারের স্বায়ত্তশাসনের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। সেজন্য উভয়ের মাঝে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্কই কাম্য। স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাঠামো, গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলি সবকিছুই জাতীয় আইন পরিষদ কর্তৃক নির্ধারিত হয়ে থাকে। আইন পরিষদ এসব কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা বৃদ্ধি কিংবা খর্ব করতে পারে না।