অথবা, প্রতিক্রিয়া কী? প্রতিক্রিয়ার শ্রেণিবিভাগ আলোচনা কর।
অথবা, প্রতিক্রিয়া কী? প্রতিক্রিয়া কত প্রকার ও কী কী? ব্যাখ্যা কর।
অথবা, প্রতিক্রিয়া কাকে বলে? প্রতিক্রিয়ার শ্রেণিবিন্যাস আলোচনা কর।
অথবা, প্রতিক্রিয়ার সংজ্ঞা দাও। প্রতিক্রিয়ার শ্রেনিবিভাগ বা প্রকারভেদ আলোচনা কর।
অথবা, প্রতিক্রিয়া কী? প্রতিক্রিয়ার শ্রেণিবিভাজন ব্যাখ্যা কর।
উত্তর।। ভূমিকা : আচরণের শ্রেণিবিভাগের সমস্যাটি সমাধান করার জন্য কোন কোন মনোবিজ্ঞানী একটি নতুন সমাধান দিয়েছেন। তারা আচরণকে সরল ও জটিল এই দুই শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। তারা বলেন যে আচরণ মাত্রই কোন না কোন উদ্দীপকের প্রতি প্রতিক্রিয়া। উদ্দীপকের সাথে যখন কোন প্রতিক্রিয়ার সমৃদ্ধ হয় তখন তা অপেক্ষাকৃত স্থায়ী হয়।এ ধরনের সংযোগই উদ্দীপক প্রতিক্রিয়া সংযোগ। যেমন- গুলির শব্দ শুনে দৌড়ে পালানো। এটি অভিজ্ঞতালব্ধ। আমাদের অনেক শিক্ষণই উদ্দীপক প্রতিক্রিয়া সংযোগ।
প্রতিক্রিয়া : উদ্দীপক যে একটি শক্তি তাতে কোন সন্দেহ নেই। দর্শন নার্ভের উদ্দীপনার ফলে যা ঘটে তার নাম প্রতিক্রিয়া।এ ক্ষেত্রে উদ্দীপক যে প্রতিক্রিয়া ঘটায় তাকে সংবেদী প্রতিক্রিয়া বলে। এর অপর নাম সংবেদন। যেমন –
একটি কবিতার লাইন মনে আসছে না। এ অবস্থায় ঐ লাইনটির আরম্ভটুকু মনে করিয়ে দিলে, এটি উদ্দীপকের কাজ করতে পারে। লাইনটির প্রথম অংশ যদি ‘কাননে কুসুম কলি হয়’, তবে ঐটুকু উল্লেখ করলেই হয়ত পরবর্তী ‘সকলি ফুটিল’ অংশটি মনে পড়ে যায়। এক্ষেত্রে মনে করিয়ে দেয়া হলো উদ্দীপকের কাজ এবং মনে আসা পরবর্তী অংশটি প্রতিক্রিয়ার কাজ। অতীতে কবিতাটি যতবার পড়া হয়েছে ততবারই প্রথম অংশের পরেই পরবর্তী অংশ পড়া হয়েছে। ফলে এই দুই অংশের মধ্যে অনুষঙ্গ সূত্র স্থাপিত হয়েছে। কাজেই কান টানলে মাথা আসে তেমন পূর্ববর্তী অংশটি মনে করিয়ে দেবার ফলে পরবর্তী অংশটি মনে পড়ে। এই ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী অংশটি মনে করিয়ে দেয়া হলো উদ্দীপক এবং পরবর্তী অংশটি মনে করিয়ে দেয়া হলো প্রতিক্রিয়া। তাই যে শক্তি উদ্দীপকের উত্তেজনার কোন ক্রিয়ায় সাড়া দেয় তাকে প্রতিক্রিয়া বলে ।
প্রতিক্রিয়া প্রকারভেদ : উদ্দীপক প্রতিক্রিয়া উৎপন্ন করে। প্রতিক্রিয়া তিন প্রকার। যথা : ১. সংবেদন, ২. পেশীর বিচলন ও ৩. গ্রন্থির রসক্ষরণ।
উদাহরণের সাহায্যে এ তিন শ্রেণির প্রতিক্রিয়া ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। যেমন- একটি তীব্র আলোক চক্ষুর বিভিন্ন অংশগুলো অতিক্রম করে অক্ষিপটে প্রতিফলিত হলো। উহাতে সন্নিহিত দর্শন নার্ভ উদ্দীপিত হলো তারপর ঐ উদ্দীপনা
নার্ভ প্রবাহরূপে মস্তিষ্কের দর্শনকেন্দ্রে পৌঁছল। সঙ্গে সঙ্গে আলোক সংবেদন রূপ প্রতিক্রিয়া ঘটলো। উত্তেজনা বা উদ্দীপকটি সংবেদীয় নার্ভের সন্নিহিত চেষ্টায় নার্ভকে উদ্দীপিত করল। ফলে চক্ষুর প্রসারণ বা সংকোচনরূপ অত্যন্ত তীব্র হলে চক্ষুর অশ্রুগন্থি উত্তেজিত হয়ে অশ্রু নিঃসরণও ঘটাতে পারে। এটিই হলো গ্রন্থীয় প্রতিক্রিয়া।
উপরের তথ্য থেকে তিন শ্রেণির প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। যথা :
১. সংবেদীয়
২. চেষ্টীয় ও
৩. গ্ৰন্থীয়।
এ তিন শ্রেণি ছাড়াও আবার তিন শ্রেণির প্রতিক্রিয়া হতে পারে। যথা:
১. সরল প্রতিক্রিয়া
২. যৌগিক প্রতিক্রিয়া ও
৩. অনুষঙ্গ প্রতিক্রিয়া।
প্রতিক্রিয়া যেমন তিন প্রকার তেমনি প্রতিক্রিয়াকালও তিন প্রকার। যথা :
১. সরল প্রতিক্রিয়াকাল
২. যৌগিক প্রতিক্রিয়াকাল
৩. অনুষঙ্গ প্রতিক্রিয়াকাল ।
ক. সরল প্রতিক্রিয়াকাল : যে প্রতিক্রিয়া মাত্র একটি উদ্দীপক হতে সরাসরি সংঘটিত হয় উহাকে সরল প্রতিক্রিয়া এবং উহাতে যে কাল ব্যয়িত হয় তাকে সরল প্রতিক্রিয়াকাল বলে। যেমন- প্রয়োগকর্তা পাত্রকে আড়াল করে একটি পর্দার পিছনে বসেন। তার নিকট একটি সুইচ থাকে, যাহা টিপামাত্রই পাত্রের নিকট স্থাপিত একটি বাল্ব জ্বলে উঠে এবং সঙ্গে সঙ্গে কাল পরিমাপক ঘড়ির কাঁটা চলতে থাকে। পর্দার অপরদিকে পাত্র আসন গ্রহণ করেন। ঐ আলোক দেখামাত্র তিনি তার নিকট স্থাপিত আর একটি সুইচ টিপে দেন, যার ফলে আলোকটি নিভে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘড়ির কাঁটা থেমে যায়।
প্রয়োগকর্তা এবার ঘড়ির কাঁটার গতির দ্বারা পরিমাপিত সময়টি লিপিবদ্ধ করে নেন
খ. যৌগিক প্রতিক্রিয়াকাল : যৌগিক প্রতিক্রিয়াকাল দুই প্রকার। যথা:
ক. ভেদ প্রতিক্রিয়াকাল ও
খ. নির্বাচন প্রতিক্রিয়াকাল।
১. ভেদ প্রতিক্রিয়াকাল : ভেদ প্রতিক্রিয়াকাল পরীক্ষা করার সময় পাত্রকে বলা হলো যে, তার সম্মুখে লাল অথবা নীল আলো জ্বালানো হবে এবং শুধু লাল আলোটি দেখলেই তিনি সুইচ টিপবেন, কিন্তু নীল আলো দেখলে তিনি কোন প্রতিক্রিয়া করবেন না। এই প্রতিক্রিয়াকাল সরল নয়, যৌগিক। কারণ এতে পাত্র আলো দেখামাত্র প্রতিক্রিয়া করেন না, কিন্তু একটি আলোকের সহিত আরেকটি আলোকের ভেদ প্রত্যক্ষ করে প্রতিক্রিয়া করেন।
২. নির্বাচন প্রতিক্রিয়াকাল : নির্বাচন প্রতিক্রিয়াকাল পরীক্ষা করার সময় পাত্রকে বলা হলো যে, তার সম্মুখে একটি লাল এবং অপর একটি নীল আলো জ্বালানো হবে। লাল আলোটি দেখামাত্র ডান হাতে এবং নীল আলোটি দেখামাত্র বাম হাতে তিনি সুইচ টিপবেন। এক্ষেত্রে ডান হাত বা বাম হাত দিয়ে দুই প্রকার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার একটিকে বেছে নিতে হয়।নির্বাচন করতে গিয়ে কিছু সময় ব্যয়িত হয়। ফলে নির্বাচন প্রতিক্রিয়াকাল সাধারণত সর্বাধিক হয়ে থাকে।
গ. অনুষঙ্গ প্রতিক্রিয়াকাল : উদ্দীপক প্রত্যক্ষভাবে অনুষঙ্গ প্রতিক্রিয়া উৎপন্ন করে না। উদ্দীপক পরোক্ষাভাবে যে প্রতিক্রিয়া করে তাকে অনুষঙ্গ প্রতিক্রিয়া বলে। কাজেই এই প্রতিক্রিয়া সরল প্রতিক্রিয়া হতে আলাদা। আবার যৌগিক
প্রতিক্রিয়ায় একাধিক উদ্দীপক উপস্থাপিত হয়, কিন্তু মাত্র একটি উদ্দীপকের উপস্থিতিতেই অনুষঙ্গ প্রতিক্রিয়া চলতে পারে।অনুষঙ্গ প্রতিক্রিয়া দুই প্রকার। যথা : ১. অবাধ প্রতিক্রিয়া ও ২. সবাধ প্রতিক্রিয়া।অবাধ অনুষঙ্গ প্রতিক্রিয়াকাল নিরূপণে পাত্রকে একটি শব্দ যেমন ‘চোর’ দেখানো বা শোনানো হয় এবং ঐ শব্দ দর্শন বা শ্রবণ করা মাত্র যে শব্দটি তার মনে আসে তাহাই বলতে বলা হয়। এ প্রতিক্রিয়ার যে সময় ব্যয়িত তাহাই অবাধ অনুষঙ্গ প্রতিক্রিয়াকাল।অনুষঙ্গ প্রতিক্রিয়া আংশিকভাবে বা সম্পূর্ণভাবে সবাধ হতে পারে। প্রথমটিতে উপস্থাপিত শব্দের জাতি বা বিশেষাত্মক শব্দ বলে প্রতিক্রিয়া করতে হয়। যেমন- ‘চোর’ শব্দটির জাতি অসাধু বলে দ্বিতীয়টিতে উপস্থাপিত প্রতিক্রিয়া করতে হয়। যেমন- চোর শব্দটির বিপরীত সাধু শব্দ বলে। সরল বা যৌগিক প্রতিক্রিয়াকালের তুলনায় অনুষঙ্গ প্রতিক্রিয়াকাল দীর্ঘ হয়ে থাকে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সংবেদন বা জ্ঞানের উপর এবং প্রতিক্রিয়া করার উপর গুরুত্ব আরোপের সহিত প্রতিক্রিয়াকালের সম্বন্ধ রয়েছে।সংবেদীয় প্রতিক্রিয়াকাল যে অপেক্ষাকৃত বেশি এবং চেষ্টায় প্রতিক্রিয়াকাল যে অপেক্ষাকৃত কম হয় তা প্রতিক্রিয়ার আলোচনা থেকে বুঝা যায়। প্রতিক্রিয়াকাল স্থির বা নির্দিষ্ট নয়। এটি কোন উদ্দীপক উপস্থাপিত হয়, তার উপর নির্ভর করে। সুতরাং, মনোবিজ্ঞানে প্রতিক্রিয়ার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।