অথবা, পেশাগত সম্পর্ক বলতে কী বুঝ? এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী?
অথবা, পেশাগত সম্পর্ক কাকে বলে? এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আলোচনা কর।
অথবা, পেশাগত সম্পর্ক কী? এর লক্ষ্যও উদ্দেশ্যগুলো লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : সমাজকর্ম একটি সক্ষমকারী প্রক্রিয়া। একটি সক্ষমকারী প্রক্রিয়া হিসেবে সমাজকর্ম ব্যক্তিকে এমনভাবে সাহায্য করে, যাতে ব্যক্তি নিজেই তার নিজের সমস্যা সমাধানে সফল হয়।এ কারণে একজন সমাজকর্মীকে সাহায্যার্থী ব্যক্তির আর্থসামাজিক ও মনোদৈহিক সমস্যা সম্পর্কে অবগত হতে হয়।আর এজন্য সাহায্যার্থী ব্যক্তির সাথে সমাজকর্মীর পেশাগত সম্পর্ক বা র্যাপো প্রতিষ্ঠা করতে হয়। পেশাগত সম্পর্ক বা র্যাপো : একজন সমাজকর্মীকে সাহায্যার্থীর সমস্যার সমাধান করতে হলে, তাকে সাহায্যার্থীর
সাথে পেশাগত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে তার সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত হতে হয়। সাহায্যার্থীর অবস্থা সম্পর্কে অবগত হওয়ার জন্য সমাজকর্মীকে সাহায্যার্থীর সাথে যে পেশাগত সুসম্পর্ক স্থাপন করতে হয় তাকে পেশাগত সম্পর্ক বা র্যাপো (Rapport) বলে।
ড. আবদুল হাকিম সরকার তাঁর ব্যক্তি সমাজকর্ম নির্দেশিকা’ (২০০০: ৬০) গ্রন্থে বলেন, “সাহায্যার্থী ও তার পরিবেশের মধ্যে অপেক্ষাকৃত ভালো সমঝোতা অর্জনের নিমিত্তে ব্যক্তি (সাহায্যার্থী) এবং সমাজকর্মীর মধ্যে আবেগ ও দৃষ্টিভঙ্গিগত যে গতিশীল ভাবের আদান-প্রদান ঘটে তাই হচ্ছে র্যাপো বা পেশাগত সম্পর্ক।”
Dictionary of Social Work’ এর সংজ্ঞানুযায়ী, “Rapport in the social work interview the state of harmony, compatibility and empathy that permits mutual understanding and a working relationship between the client and the social worker.”
সৈয়দ শওকতুজ্জামান তাঁর ব্যক্তি ও দল সমাজকর্ম’ (২০০২: ৮৯) গ্রন্থে বলেন, “পেশাগত উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে মক্কেলের সাথে সমাজকর্মীর যে গতিশীল সম্পর্ক গড়ে উঠে তাকে মক্কেল-কর্মী সম্পর্ক বলে।”
উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে আমরা বলতে পারি, একজন সাহায্যার্থীর সমস্যার কার্যকারণ সম্পর্ক আবিষ্কার করে সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে সমাজকর্মীকে সাহায্যার্থী ব্যক্তির সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়।সাহায্যার্থীর সাথে সমাজকর্মীর এ সম্পর্ককে পেশাগত সম্পর্ক বা র্যাপো বলে।
পেশাগত সম্পর্কের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য : পেশাগত সম্পর্ক বা র্যাপোর প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো ব্যক্তির সমস্যার সমাধান। এ সম্পর্কে Compton এবং Galaway বলেন, “The purpose of the rapport was described as creating and at and atmosphere. The development of personality, a better solution of client problems, the means for carrying out function stating and focusing reality and emotional problems and helping the client make a more acceptable adjustment to a personal problem.”
Compton এবং Galaway এর বক্তব্যের আলোকে আমরা পেশাগত সম্পর্কের নিম্নোক্ত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে পারি:
১. সমস্যা সম্পর্কে অবহিত হওয়া : র্যাপো বা পেশাগত সম্পর্কের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য হলো সাহায্যার্থীর সমস্যার ধরন ও প্রকৃতি সম্পর্কে জানা। সাহায্যার্থী আর্থসামাজিক, মনো-দৈহিক না অন্য কোন সমস্যায় জড়িত পেশাগত সম্পর্কের মাধ্যমে তা জানা যায়।
২. সমস্যা সমাধানের উপায় উদ্ভাবন : ব্যক্তির সমস্যার ধরন ও প্রকৃতি সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পর সে সমস্যাকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সমাধানের পন্থা উদ্ভাবন করাও পেশাগত সম্পর্কের একটি অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
৩. সমস্যা সমাধানের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি : র্যাপোর একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হলো ব্যক্তির সমস্যা সমাধানের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা। অর্থাৎ ব্যক্তি ও সমাজকর্মীর পারস্পরিক সহযোগিতা সৃষ্টির মাধ্যমে পেশাগত সম্পর্ক ব্যক্তির
সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে অনুকূল পরিবেশ গড়ে উঠতে সাহায্য করে।
৪. ব্যক্তির মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করা : সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সাহায্যার্থীর মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করে তোলাও র্যাপোর অন্যতম উদ্দেশ্য। আমরা জানি, সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির মধ্যে হতাশা, দুর্বলতা বিরাজ করে, সে অসহায়ত্ব অনুভব করে, নিজেকে বড় একা মনে করে, এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের মাধ্যমে ব্যক্তির মধ্যে আত্মপ্রত্যয় জাগিয়ে তোলা র্যাপোর অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
৫. সমস্যা সম্পর্কিত বাস্তব তথ্যসংগ্রহ : পেশাগত সম্পর্কের অপর একটি উদ্দেশ্য হলো ব্যক্তির সমস্যা সম্পর্কিত বাস্তব তথ্যসংগ্রহ করা। সমাজকর্মী ব্যক্তির অর্থনৈতিক, সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক বা অন্য কোন সমস্যা বিষয়ক তথ্য পেশাগত সম্পর্ক সৃষ্টির মাধ্যমে সংগ্রহ করতে পারেন।
৬. ব্যক্তির দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে অবহিত হওয়া : পেশাগত সম্পর্কের মাধ্যমে ব্যক্তির দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। সমাজকর্মী এর সাহায্যে জানতে পারেন সাহায্যার্থীর সমস্যা কি ও সমস্যার গভীরতা কতটুকু।
৭. ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের ধরন সম্পর্কে জানা : ব্যক্তির সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে অবশ্যই ব্যক্তির ধরন সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। এ কারণে পেশাগত সম্পর্কের একটি অন্যতম লক্ষ্য হলো, ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের ধরন সম্পর্কে অবহিত হওয়া।
৮. ব্যক্তির পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে জানা : পারিপার্শ্বিক অবস্থাও ব্যক্তির সমস্যার সমাধানের জন্য দায়ী হতে পারে। এ কারণে পেশাগত সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে ব্যক্তির পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কেও অবহিত হওয়া যায়।
৯. সমস্যা সমাধানের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি : পেশাগত সম্পর্কের অপর একটি লক্ষ্য হলো ব্যক্তির সমস্যা সমাধানের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা। সাহায্যার্থী যাতে সফল ব্যক্তি হিসেবে গড়ে উঠতে পারে র্যাপো সেক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
১০. ব্যক্তির আচরণকে বাঞ্ছিত ক্ষেত্রে প্রভাবিত করা : ব্যক্তির আচরণকে বাঞ্ছিত ক্ষেত্রে প্রভাবিত করা র্যাপোের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য। সমাজকর্মী ব্যক্তিকে বুঝিয়ে, প্রণোদিত করে অথবা সমাজকর্মের পদ্ধতি প্রয়োগ করে ব্যক্তির
আচরণকে প্রত্যাশিত পথে পরিবর্তন করতে পারেন।
১১. ব্যক্তির সুপ্ত ক্ষমতার বিকাশ : ব্যক্তির সুপ্ত ক্ষমতার বিকাশ সাধন করা এবং ব্যক্তির নিজের সমস্যা নিজের দ্বারা সমাধানের লক্ষ্যে ব্যক্তিকে সক্ষম করে তোলা পেশাগত সম্পর্কের সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য।
১২. ব্যক্তির মনের ব্যথা-বেদনার উপশম : ব্যক্তির মধ্যে অনেক গোপন ব্যথা-বেদনা, হতাশা, কষ্ট, যন্ত্রণা ইত্যাদি লুকিয়ে থাকে।এসব লুক্কায়িত যন্ত্রণা থেকে ব্যক্তিকে পরিত্রাণ দেওয়ায়ও পেশাগত সম্পর্কের উদ্দেশ্য।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, ব্যক্তির সমস্যার কার্যকারণ সম্পর্ক আবিষ্কার, ব্যক্তির মধ্য থেকে হতাশা ও ভয়ভীতি দূর করে ব্যক্তিকে তার সামাজিক ভূমিকা যথাযথভাবে পালনে সক্ষম করে তোলাই পেশাগত সম্পর্কের মূল উদ্দেশ্য। পেশাগত সম্পর্ক ব্যক্তির সমস্যা সমাধানের মূলভিত্তি প্রস্তুত করে।