অথবা, বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারগুলোর আয় ও ব্যয়ের খাতসমূহের বিবরণ দাও।
অথবা, বাংলাদেশের স্থানীয় সংস্থাসমূহের আয় ও ব্যয়ের খাতসমূহের বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধর।
উত্তর৷ ভূমিকা : প্রশাসনিক সুবিধার জন্য একটি দেশকে কতিপয় প্রশাসনিক ভাগে বিভক্ত করা হয়। এ ভাগগুলোর সীমিত কর্তৃত্বসম্পন্ন সংগঠন থাকে, এরূপ সংগঠনকে স্থানীয় সরকার বা স্থানীয় শাসন বলা হয়। বাংলাদেশে তিন স্তর বিশিষ্ট স্থানীয় সরকার কাঠামো বিদ্যমান। যথা : জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ এবং ইউনিয়ন পরিষদ। এসব স্থানীয় সংস্থাগুলোর নির্দিষ্ট আয়ের উৎসসমূহ রয়েছে সাথে ব্যয়ের খাতসমূহও বিদ্যমান।
বাংলাদেশের স্থানীয় সংস্থাসমূহ : বাংলাদেশে তিন স্তর বিশিষ্ট স্থানীয় সরকার স্থানীয় সংস্থাগুলো হলো জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, ও ইউনিয়ন পরিষদ। এদের প্রত্যেকের রয়েছে সু-নির্দিষ্ট কাঠামো স্তর। রয়েছে যথাযথ আয় ও ব্যায়ের খাতসমূহ । নিম্নে পর্যায়ক্রমে স্থানীয় সংস্থাগুলোর আয়ের উৎসসমূহ ও ব্যয়ের খাতসমূহ তুলে ধরা হলো :
জেলা পরিষদের আয়ের উৎসসমূহ : বাংলাদেশে ১৯৮৮ সালে জেলা পরিষদ আইন পাস করে প্রত্যেকটি জেলায় একটি জেলা পরিষদ গঠন ও চালু করা হয়। জেলা পরিষদ আইন, ২০০০ এর ৪২ নং ধারা অনুযায়ী (১) জেলা পরিষদ তহবিল নামে প্রত্যেক পরিষদের একটি তহবিল থাকবে। নিম্নে জেলা পরিষদের আয়ের উৎসসমূহ বর্ণনা করা হলো :
ক. ২০০০ এর ৪২ নং ধারা অনুযায়ী (১) জেলা পরিষদ আইন দ্বারা গঠিত পরিষদ যে জেলা পরিষদের উত্তরাধিকারী সেই জেলা পরিষদের তহবিলের উদ্বৃত্ত অর্থ ।
খ. পরিষদ কর্তৃক ধার্যকৃত কর, রেইট, টোল, ফিস এবং অন্যান্য দাবি বাবদ প্রাপ্ত অর্থ ।
গ. পরিষদের উপর ন্যস্ত এবং তৎ কর্তৃক পরিচালিত সকল সম্পত্তি হতে প্রাপ্ত আয় বা মুনাফা ।
ঘ. সরকার বা অন্যান্য কর্তৃপক্ষের অনুদান।
ঙ. কোনো স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি কর্তৃক প্রদত্ত অনুদান।
চ. পরিষদের উপর ন্যস্ত সকল ট্রাস্ট হতে প্রাপ্ত আয়।
ছ. পরিষদের অর্থ বিনেয়োগ হতে মুনাফা।
জ. পরিষদ কর্তৃক প্রাপ্ত অন্য যে কোনো অর্থ ।
ঝ, সরকারের নির্দেশক্রমে পরিষদের উপর ন্যস্ত অন্যান্য আয়ের উৎস হতে প্রাপ্ত অর্থ ।
জেলা পরিষদের ব্যয়ের খাতসমূহ : নিম্নে জেলা পরিষদের ব্যয়ের খাতসমূহ তুলে ধরা হলো :
ক. উপজেলা পরিষদ ও পৌরসভা কর্তৃক গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্পসমূহের বাস্তবায়ন।
খ. উপজেলা, পৌরসভা বা সরকার কর্তৃক সংরক্ষিত নয় এই প্রকার জনপথ, কালভার্ট ও ব্রিজ এর নির্মাণ রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন।
গ. সরকার কর্তৃক জেলা পরিষদের উপর অর্পিত উন্নয়ন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন।
ঘ. সরকার কর্তৃক আরোপিত যে কোনো কাজ।
ঙ. জেলা পরিষদের সমাজকল্যাণমূলক বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন।
চ. অর্থনৈতিক কল্যাণে জেলা পরিষদের বিভিন্ন কাজের বাস্তবায়ন।
ছ. জেলা পরিষদের শিক্ষা সংক্রান্ত ব্যয় এবং জনস্বাস্থ্যমূলক কার্যক্রমগুলোর ব্যয়
এছাড়াও জেলা পরিষদ বিভিন্ন খাতে ব্যয় করে থাকে।
উপজেলা পরিষদের আয়ের উৎসসমূহ : উপজেলা ব্যবস্থা একদিকে যেমন স্থানীয় শাসন, অন্যদিকে তেমনি স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন। পল্লি এলাকার প্রশাসন, শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা, উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়ে উপজেলা পরিষদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নে উপজেলা পরিষদের আয়ের উৎসসমূহ তুলে ধরা হলো।
ক. উপজেলার আত্ততার্ভুক্ত এলাকায় অবস্থিত সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হাটবাজার, হস্তান্তরিত জলমহাল ও ফেরিঘাট হতে ইজারালব্ধ আয় ।
খ. নাটক, থিয়েটার ও যাত্রার উপর করের অংশ এবং যে সকল উপজেলায় পৌরসভা নেই সেখানে থানা সদরে অবস্থিত সিনেমার উপর কর।
গ. বেসরকারিভাবে আয়োজিত মেলা, প্রদর্শনী ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের উপর ধার্যকৃত ফি।
ঘ. ইউনিয়ন পরিষদের নির্ধারিত খাত এবং সংশ্লিষ্ট উপজেলার আত্ততা বহির্ভূত খাত ব্যতীত বিভিন্ন ব্যবসা, বৃত্তি ও পেশার উপর পরিষদ কর্তৃক প্রদত্ত লাইসেন্স ও পারমিটের উপর ধার্যকৃত ফি।
চ. পরিষদ কর্তৃক প্রদত্ত সেবার উপর ধার্যকৃত ফিস।
ছ. সরকার কর্তৃক সময়ে সময়ে নির্দেশত অন্য কোনো খাতে উপর আরোপিত কর, রেইট, টোল, ফিস বা অন্য কোনো উৎস হতে অর্জিত আয় ।
এছাড়াও উপজেলা পরিষদের আরো কতিপয় আয়ের উৎস রয়েছে।
উপজেলা পরিষদের ব্যয়ের খাতসমূহ : উপজেলা পরিষদের আয় যেমনি ব্যয়ও তদ্রুপ বেশি। নিয়ে কতিপয় ব্যয় তুলে ধরা হলো :
পরিষদের নিকট হস্তান্তরিত বিভিন্ন দপ্তরের কর্মসূচি বাস্তবায়ন জনিত ব্যয়।
খ. আন্তঃ ইউনিয়ন সংযোগকারী রাস্তা নির্মাণ, মেরাতম ও রক্ষাণাবেক্ষণ জনিত ব্যয়।
গ. জনস্বাস্থ্য, পুষ্টি ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা নিশ্চিতকরণ জনিত ব্যয়।
ঘ. স্যানিটেশন ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নতি সাধন এবং সুপেয় পানীয় জলের সরবরাহ ব্যবস্থা গ্রহণজনিত ব্যয়।
ঙ. উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষা প্রসারের জন্য উদ্বুদ্ধকরণ এবং সহায়তাজনিত ব্যয়।
চ. কুটিরশিল্পের বিকাশ সাধন এবং ক্ষুদ শিল্পের প্রসারের জন্য ব্যবস্থাজনিত ব্যয়।
ছ. সমবায় সমিতি ও বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের কাজে সহায়তা প্রদান।
জ. মহিলা, শিশু, সমাজকল্যাণ এবং যুব, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে সহায়তা প্রদান।
এছাড়াও উপজেলা পরিষদ আরো বিভিন্ন কাজে অর্থ ব্যয় করে থাকে।
ইউনিয়ন পরিষদের আয়ের উৎসসমূহ : ইউনিয়ন পরিষদের একাধিক আয়ের উৎস আছে। স্থানীয় সরকার আই ২০০৯ অনুযায়ী চতুর্থ তফসিলের ৬০ হতে ৭০ ধারা বর্ণিত আয়ের উৎসগুলো হলো :
ক. নির্ধারিত পদ্ধতিতে আরোপিত ইমারত/ভূমির বার্ষিক মূল্যের উপর কর অথবা ইউনিয়ন রেইট ।
খ. পেশা, ব্যবসা এবং বৃত্তির উপর কর।
গ. ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃক প্রদত্ত লাইসেন্স এবং পারমিটের উপর ফি।
ঘ. ইউনিয়ন সীমানার মধ্যে হস্তান্তরিত জলমহাল এর সরকার নির্ধারিত অংশ।
ঙ. সিনেমা, ড্রামা ও নাট্য প্রদর্শনী এবং অন্যান্য আমোদ প্রমোদ এবং চিত্তবিনোদনের উপর কর।
চ. স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর কর বাবদ আয়ের অংশ এবং নিকাহ নিবন্ধন ফি ।
ছ. বিজ্ঞাপনের উপর কর এবং সরকার কর্তৃক মঞ্জুরকৃত অর্থ।
জ. বিবিধ।
ইউনিয়ন পরিষদের ব্যয়ের খাতসমূহ : ইউনিয়ন পরিষদের ব্যয়ের খাতসমূহ নিম্নে তুলে ধরা হলো :
ক. জনকল্যাণমূলক কার্যাবলি : ইউনিয়ন পরিষদ জনকল্যাণের জন্য অর্থ ব্যয় করে থাকে। যেমন রাস্তাঘাট সংরক্ষণ,
বিদ্যুৎ এর ব্যবস্থা, খেলার মাঠ, উদ্যান, গোরস্থান এবং শ্মশান নির্মাণ। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য কূপ-নলকূপ, পুকুর
খনন, বন্যা, ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড় প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলাসহ বহুবিধ কল্যাণমূলক কাজের পিছনে ব্যয়।
খ. উন্নয়নমূলক কার্যাবলি : ইউনিয়ন পরিষদের মূল কাজই হচ্ছে ইউনিয়নের সার্বিক উন্নয়ন করা। এই উন্নয়নের
যাবতীয় ব্যয়ভার ইউনিয়ন পরিষদ বহন করে। যেমন- বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, কালভার্ট নির্মাণ ও সেচের ব্যবস্থা করা। অবকাঠামো নির্মাণ, রাস্তাঘাট মেরামত জনিত ব্যয় ইত্যাদি।
গ. শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষাজনিত ব্যয় : ইউনিয়ন পরিষদ গ্রামের চোর-ডাকাতের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী, গ্রামীণ পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করে এবং পরিচালনা করে। এদের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করে।
ঘ. শিক্ষামূলক এবং বিচার সংক্রান্ত কার্যাবলিজনিত ব্যয় : ইউনিয়ন পরিষদ কিছু শিক্ষা বিষয়ক কার্যাবলি পরিচালনা করে থাকে এবং কিছু বিচার সংক্রান্ত কার্যাবলি পরিচালনা করে থাকে এবং এগুলোর পিছনে ব্যয় করে ।
উপসংহার : আলোচনার পরিশেষে বলতে পারি যে, বাংলাদেশের স্থানীয় সংস্থাসমূহের যেমনি ব্যয় তদনুযায়ী আয় নেই। আয়ের অভাবে ব্যয় সঠিকভাবে সম্পাদন করা যায় না। এসব স্থানীয় সংস্থা অনেক সময় কেন্দ্রের উপর নির্ভরশীল থাকে। এসব স্থানীয় সংস্থা প্রকৃতপক্ষে স্থানীয় পর্যায়ে সরকারের বিকল্প হিসেবে কাজ করে এবং স্থানীয় সমস্যার
স্থানীয়ভাবেই সমাধান করার চেষ্টা করে।